নিচতলার এগজস্ট ফ্যানের তার গলে আগুন

ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত—হাসেম ফুডসের কারখানায় অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় প্রাণহানি বেশি হয়েছে।

নারায়ণগঞ্জের হাসেম ফুডস লিমিটেডের কারখানায় আগুন।ফাইল ছবি

অতিরিক্ত তাপে নিচতলার একটি এগজস্ট ফ্যানের তার গলে হাসেম ফুডসের কারখানায় আগুনের সূত্রপাত হয়। সেখানে অনেক দাহ্য পদার্থ থাকায় দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া ওই কারখানায় অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এ কারণেই প্রাণহানি বেশি হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের তদন্তে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই কারখানায় অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে যে পরিকল্পনা (ফায়ার প্ল্যান) বাস্তবায়ন করার কথা, সেটা করা হয়নি। কারখানার কোনো কর্মীর আগুন নেভানোর (ফায়ার ফাইটিং) প্রশিক্ষণ ছিল না। সেখানে প্রশিক্ষিত কর্মী থাকলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার আগেই হয়তো আগুন নিয়ন্ত্রণ করা যেত। আটকে পড়া কর্মীদের দ্রুত বের করার ক্ষেত্রেও ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হতো।

৮ জুলাই বিকেলে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের হাসেম ফুডস লিমিটেডের কারখানার ছয়তলা ভবনে আগুন লাগে। ১৯ ঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। পরে ওই ভবনের চারতলার একটি কক্ষ থেকে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া ৪৯টি লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস। তার আগে তিন শ্রমিক লাফিয়ে পড়ে মারা যান।

এই ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল জিল্লুর রহমানকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি তদন্তকাজ শেষ করেছে। শিগগির তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে বলে গতকাল প্রথম আলোকে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসাইন।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তদন্তে এসেছে যে আগুন লাগার পর চারতলা থেকে ছাদে ওঠার চেষ্টা করেছিলেন আটকে পড়া অনেক কর্মী। সিঁড়ি আটকানো থাকার কারণে বের হতে না পেরে তাঁরা চারতলার একটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আগুন পুরো কারখানায় ছড়িয়ে পড়লে তাঁরা সেখানে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যান।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, একটি কারখানায় যে ধরনের অগ্নিনিরাপত্তা থাকা দরকার, রূপগঞ্জের কারখানায় সেটি ছিল না। কারখানার ভেতরে বিভিন্ন ফয়েল পেপার, প্যাকেট তৈরির উপকরণ ও বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক পণ্য ছিল, যার অধিকাংশই দাহ্য পদার্থ। ফলে এগজস্ট ফ্যানের বৈদ্যুতিক তার গলে সৃষ্ট আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তিনি বলেন, কারখানার ভেতরে থাকা প্রায় সবকিছুই পুড়ে গেছে। তাই সেগুলো সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছিল কি না, সেটি বোঝার কোনো উপায় ছিল না। তবে সঠিক ব্যবস্থাপনা থাকলে এ ধরনের ঘটনা ঘটত না।

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক বলেন, এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে কারখানাসহ সব ধরনের ভবনে অগ্নিনিরাপত্তায় সঠিক পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন জরুরি। এই বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে সুপারিশ থাকবে।

ফায়ার সার্ভিসের তদন্তে প্রাপ্ত তথ্যের বিষয়ে জানতে চাইলে সজীব গ্রুপের জ্যেষ্ঠ মহাব্যবস্থাপক কাজী আবদুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে তিনি কিছু বলতে পারবেন না। যিনি বলতে পারবেন, তিনি কারাগারে।

এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে কারখানার মালিক আবুল হাসেমসহ আটজনের বিরুদ্ধে রূপগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা করে। ওই মামলায় ১০ জুলাই আবুল হাসেম, তাঁর চার ছেলেসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে হাসেম ও তাঁর চার ছেলে জামিনে মুক্তি পান। হাসেম ফুডসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহান শাহ আজাদ, উপমহাব্যবস্থাপক মামুনুর রশিদ, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দিন বর্তমানে কারাগারে।

মামলাটি এখন তদন্ত করছে সিআইডি। আসামিদের জামিনের আগেই রিমান্ড আবেদন করেছিলেন তদন্ত কর্মকর্তা। এখনো রিমান্ডের শুনানি হয়নি। তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক আতাউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এই মামলার প্রধান আসামিসহ গ্রেপ্তার পাঁচজন জামিনে আছেন। প্রয়োজনে আদালতের অনুমতি নিয়ে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

সময় বাড়িয়েছে দুই কমিটি

এই ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরও তদন্ত কমিটি গঠন করে। ওই দুই কমিটিই সময় বাড়িয়েছে।

জেলা প্রশাসন বলছে, কীভাবে আগুন লেগেছে, কারও গাফিলতি আছে কি না, অগ্নিনিরাপত্তায় কোনো কার্যকর ব্যবস্থা ছিল কি না—এসব বিষয় ছাড়াও তদন্তে আরও অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হচ্ছে। কারখানার বিমাসংক্রান্ত বিষয়, তাদের ব্যাংকিং লেনদেনও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের ক্ষতিপূরণ কীভাবে নির্ধারণ করা হবে, তদন্ত প্রতিবেদনে এই বিষয়ও সুপারিশ আকারে থাকবে। তাই নির্ধারিত সাত কার্যদিবসে তদন্ত শেষ করা সম্ভব হয়নি।

তদন্ত কমিটির প্রধান নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম ব্যাপারী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এরই মধ্যে তদন্তের ৭০ শতাংশ কার্যক্রম শেষ হয়েছে। তবে করোনা বিধিনিষেধের কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। এ কারণে আরও ১০ কার্যদিবস সময় বাড়ানো হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে।

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর বলছে, নির্ধারিত পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে পারেনি তাদের কমিটি। আরও পাঁচ কার্যদিবস সময় বাড়ানো হয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির প্রধান ও সংস্থাটির যুগ্ম মহাপরিদর্শক ফরিদ আহমেদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা আশা করছেন, তদন্ত শেষ করে শিগগির প্রতিবেদন জমা দিতে পারবেন।