নিজ দপ্তরে দুই ব্যবসায়ীকে পেটালেন রাজউক পরিচালক

প্রতীকী ছবি

পাওনা টাকা আদায়ে দুই ব্যবসায়ীকে পৃথকভাবে নিজের দপ্তরে ডেকে এনে পেটানোর অভিযোগ উঠেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পরিচালক শেখ শাহীনুল ইসলামের বিরুদ্ধে। এ বছরের জানুয়ারি এবং সেপ্টেম্বর মাসে রাজউকের প্রধান কার্যালয়ে তাঁর দপ্তরেই ঘটনা দুটি ঘটে। এ নিয়ে দুই ব্যবসায়ী প্রথমে থানায় গেলেও পুলিশ মামলা নেয়নি। পরে গত ২৫ অক্টোবর শাহীনুলসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করা হয়।

মারধরের শিকার দুই ব্যবসায়ী হলেন ওয়াসী উদ্দিন আহমেদ ও রায়হান আহমেদ। তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, রাজউকের পরিচালক শেখ শাহীনুল ইসলামের ভাগনে রাকিবুল হাসান তাঁদের ব্যবসায়িক অংশীদার। রাকিবুলের মাধ্যমেই শাহীনুলের সঙ্গে তাঁদের পরিচয়। এরপর ব্যবসায় বিনিয়োগের জন্য দুই দফায় সুদে মোট এক কোটি টাকা তাঁরা শাহীনুলের কাছ থেকে নেন। প্রথম দফায় নেওয়া ৫০ লাখ টাকার চুক্তিপত্রে শাহীনুলের সই রয়েছে। দ্বিতীয় দফায় দেওয়া টাকার চুক্তিপত্রে রাকিবুলের সই রয়েছে।

ওয়াসী, রায়হান ও তাঁদের আরেক বন্ধু মোস্তফা মাহমুদুল হাসান মিলে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে ২০১১ সালে হেডরন কেমিক্যালস লিমিটেড গড়ে তোলেন। তাঁরা একধরনের রাসায়নিক উৎপাদন করেন, যা কিছু প্লাস্টিক পণ্যের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। গত বছরের ডিসেম্বর থেকে তাঁরা এই রাসায়নিক চীনে রপ্তানি করছেন।

অভিযোগ ওঠা শেখ শাহীনুল ইসলাম রাজউকের এস্টেট ও ভূমি-২–এর পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন। পূর্বাচলের প্লটগুলো দেখভালের দায়িত্ব তাঁর। ২১ নভেম্বর র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া গোল্ডেন মনির ওরফে মনির হোসেনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৯ ডিসেম্বর শেখ শাহীনুল ইসলামকে ডেকেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু তিনি দুদকে উপস্থিত হননি।

এ বিষয়ে দুদকের মুখপাত্র প্রণব কুমার ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, শাহীনুল ইসলাম দুদকে না আসার পেছনে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা বিবেচনা করে আবারও তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদে উপস্থিত হওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া হবে।

রাজউক কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকায় ২০২টি প্লট দখলের অভিযোগ রয়েছে গোল্ডেন মনিরের বিরুদ্ধে। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে দুদক।

হেডরন কেমিক্যালস কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা মাহমুদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, রাজউক পরিচালক তাঁদের কাছে টাকা পান, এটা তাঁরা কখনোই অস্বীকার করেননি। তাঁর সঙ্গে লেনদেনের সব তথ্য ও প্রমাণ তাঁরা নিজেদের কাছে রেখেছেন। সাড়ে ৩২ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। বাকি ৯৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিতেও তাঁরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

মারধরের শিকার ব্যবসায়ী ওয়াসী ও রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৬ সালের জুলাই মাসে ৩০ শতাংশ সুদে তাঁরা শেখ শাহীনুল ইসলামের কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকা নেন। এর চুক্তিপত্র তাঁদের কাছে রয়েছে। এই টাকার সুদ পরিশোধের পর আরও ৫০ লাখ টাকা তাঁদের ধার দিয়েছেন শাহীনুল। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ৩২ লাখ ৫০ হাজার টাকা তাঁরা পরিশোধ করেছেন। কিন্তু গত বছরের শেষের দিকে চীনে এবং এ বছরের মার্চ থেকে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে তাঁদের ব্যবসা ভালো চলছে না। টাকা ফেরত দিতে দেরি হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে রাজউকের প্রধান কার্যালয়ে নিজের দপ্তরে ডেকে নিয়ে তাঁদের পৃথকভাবে মারধর করেন শাহীনুল।

অভিযোগের বিষয়ে রাজউকের পরিচালক শেখ শাহীনুল ইসলামের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথমে জিজ্ঞাসা করেন, কোন ব্যবসায়ী এই অভিযোগ করেছে। হেডরন ক্যামিকেলসের নাম বলার পর তিনি উত্তর দেন, ‘যে তিনজন অভিযোগ করেছেন, তাঁদের জিজ্ঞাসা করেন আমি কে, আমি একজন সরকারি কর্মকর্তা।’ এরপর ‘সরি ব্রাদার, থ্যাংকস’ বলে তিনি ফোনটি কেটে দেন। এরপর ফোন দিলেও তিনি আর ধরেননি।

শাহীনুল ইসলামের ভাগনে রাকিবুল হাসানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি এ বিষয়ে সামনাসামনি কথা বলবেন বলে জানান। পরে তিনি সোমবার এই প্রতিবেদকের দেখা করবেন বলে কথা দেন। শেষ পর্যন্ত তিনি আসেননি। এরপর থেকে আর ফোন দিলেও ধরেন না রাকিবুল।

মারধরের শিকার ব্যবসায়ীরা বলেন, নির্যাতনের প্রতিকার চেয়ে তাঁরা মতিঝিল থানার পুলিশের দ্বারস্থ হন। কিন্তু পুলিশ মামলা না নেওয়ায় ২৫ অক্টোবর আদালতে অভিযোগ করেন তাঁরা। আদালতের নির্দেশে অভিযোগটি এখন তদন্ত করছে মতিঝিল থানা। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও সচিব, দুদকের চেয়ারম্যান, পুলিশ মহাপরিদর্শক এবং রাজউকের চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন তাঁরা।

যে তিনজন অভিযোগ করেছেন, তাঁদের জিজ্ঞাসা করেন আমি কে, আমি একজন সরকারি কর্মকর্তা।
শেখ শাহীনুল ইসলাম, রাজউকের পরিচালক

এ বিষয়ে রাজউক চেয়ারম্যান মো. সাঈদ নূর আলম গতকাল শুক্রবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবসায়ীদের এমন অভিযোগের বিষয়ে তাঁর জানা নেই। ব্যবসায়ীরা লিখিতভাবে জানিয়েছেন, এ কথা বলার পর তিনি বলেন, লিখিত অভিযোগটি তিনি খুঁজে দেখবেন। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে শেখ শাহীনুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আদালতে দেওয়া লিখিত অভিযোগে ব্যবসায়ী রায়হান আহমেদ উল্লেখ করেছেন, প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক কার্যক্রমের আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়ায় চুক্তির ১ কোটি টাকা তাঁরা পরিশোধ করতে পারেননি। তবে তিন দফায় ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন। বাকি টাকা দফায় দফায় পরিশোধের জন্য তাঁরা সময় চেয়ে আসছিলেন। ২২ জানুয়ারি তাঁদের কোম্পানির নির্বাহী পরিচালক ওয়াসী উদ্দিন আহমেদকে নিজ কার্যালয়ে ডেকে নেন শাহীনুল ইসলাম। ওয়াসী উদ্দিন গিয়ে টাকা পরিশোধের জন্য সময় চান। তখন শাহীনুলের নির্দেশে সেখানে থাকা জাহিদুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি তাঁকে মারধর করেন। এ ঘটনার পর শাহীনুলকে তাঁরা আরও ১০ লাখ টাকা পরিশোধ করেন।

লিখিত অভিযোগে আরও বলা হয়, ২০ সেপ্টেম্বর শাহীনুল ইসলাম মুঠোফোনে ব্যবসায়ী রায়হানকে তাঁর কার্যালয়ে ডেকে নেন। পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুযায়ী রায়হান রাজউকে শাহীনুল ইসলামের কার্যালয়ে গিয়ে ২০২১ সালের মে মাসের মধ্যে পাওনা টাকা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেন। এতে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে রায়হানকে মারধর করেন। এরপর তিনি তাঁর ভাগনে রাকিবুল হাসান ও তাঁর অনুসারী জাহিদুল ইসলামকে ডেকে আনেন। তাঁরা দুজন আবারও রায়হানকে মারধর করে রক্তাক্ত করেন। এরপর একটি গাড়িতে করে রায়হানকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অস্ত্র ঠেকিয়ে ১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা পাওনার স্ট্যাম্পে তাঁর সই নেওয়া হয়।

শাহীনুল ইসলাম দুদকে না আসার পেছনে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা বিবেচনা করে আবারও তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদে উপস্থিত হওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া হবে।
প্রণব কুমার ভট্টাচার্য, দুদকের মুখপাত্র

আদালতে করা অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত করছেন মতিঝিল থানার উপপরিদর্শক আবদুর রাজ্জাক। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, তাঁর কাছে অভিযোগটি এসেছে এক মাস হয়েছে। ঘটনাটি তিনি খতিয়ে দেখছেন। আদালতকে প্রতিবেদন দিয়ে তদন্তের ফল জানানো হবে।

মারধরসংক্রান্ত ঘটনার কয়েকটি অডিও রেকর্ড, ভিডিও এবং কিছু ছবি সংগ্রহ করেছে প্রথম আলো। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ব্যবসায়ী রায়হান রাজউকে শাহীনুল ইসলামের কক্ষে প্রবেশ করেছেন। একটি অডিওতে শোনা যায়, শাহীনুল রায়হানকে গালমন্দ করছেন এবং হুমকি দিচ্ছেন।

হেডরন কেমিক্যালস কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা মাহমুদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, রাজউক পরিচালক তাঁদের কাছে টাকা পান, এটা তাঁরা কখনোই অস্বীকার করেননি। তাঁর সঙ্গে লেনদেনের সব তথ্য ও প্রমাণ তাঁরা নিজেদের কাছে রেখেছেন। সাড়ে ৩২ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। বাকি ৯৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিতেও তাঁরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু ব্যবসার মন্দার কারণে তাঁরা টাকা ফেরত দিতে পারছেন না। কিন্তু শাহীনুল কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে শুধু মারধরই করেননি, দক্ষিণ বনশ্রীর বাসায় (মাহমুদুলের বাসা) দুইবার সন্ত্রাসী পাঠিয়ে হত্যার হুমকিও দিয়েছেন। প্রতি মুহূর্তে তাঁরা প্রাণনাশের ভয়ে থাকছেন।