নিরন্তর ভাষাসংগ্রামী

মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান

‘রাজশাহী কলেজের ফিজিকস বিল্ডিংয়ের নিচে দাঁড়িয়ে রেডিও সম্প্রচার থেকে জিন্নাহ সাহেবের সেই ভাষণ আমি শুনি যখন তিনি একতরফাভাবে ঘোষণা করলেন, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” সেদিন আমি মনে খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। কখন আমার মনের গহনে (হয়তো সমমনা অনেকের অন্তরেও) একটা বিশিষ্টতাবোধ অগোচরে সঞ্চারিত হয়ে গেল! এরপর বাংলা ভাষাবিরোধী প্রতিটি উক্তি ও আচরণ সেই বিশিষ্টতাবোধকে পুষ্টি দান করতে থাকে।’ (মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, ‘একুশের স্মৃতিচারণ’, একুশের সংকলন, বাংলা একাডেমি, ১৯৮০)

রাজশাহী কলেজের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান (৩ ডিসেম্বর ১৯২৮—১১ জানুয়ারি ২০১৪) পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরে জড়িয়ে পড়েন বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে।

বায়ান্নর ভাষাসংগ্রামী

২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি হলে যে কজন ছাত্র ফজলুল হক হলের পুকুরপাড়ে বসে গভীর রাতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে মত দেন, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ছিলেন তাঁদের অন্যতম। পরদিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের সভায় ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত এবং ১০ জন করে দল বেঁধে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক পেরিয়ে রাস্তায় ওঠার পরিকল্পনা হয়। তিনি প্রথম বা দ্বিতীয় দলের নেতৃত্বে ছিলেন। বেশ কিছুদিন কারারুদ্ধ থেকে তিনি মুক্তি পান ১১ মার্চে। পরের ঘটনা চমকপ্রদ।

আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘খবরটা মনে হয় পড়েছিলাম মর্নিং নিউজ-এ। রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে কারাবাসের দায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের সদ্যনিযুক্ত প্রভাষক মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নিয়োগ বাতিল হয়ে গেছে। তিনি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিংহদ্বারে বুকে ট্রে ঝুলিয়ে সিগারেট বিক্রি করছেন এবং এই চলমান দোকানের নাম দিয়েছেন শেলী’জ ওন শপ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেলী ভাইয়ের (তাঁর ডাকনাম) নিতান্ত অস্থায়ী নিয়োগ ঘটেছিল তাঁর কারাজীবনের পরে। তাঁর মতো পূর্বাপর মেধাবী ছাত্রের পক্ষে এই নিয়োগ লাভ ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু আইন ভঙ্গকারী জেলখাটা যুবকের বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগে সরকার তাদের অসন্তোষের কথা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের গোচরে আনে। বিভাগীয় অধ্যক্ষ আবদুল হালিম সে-কথা শেলী ভাইকে জানান। শেলী ভাই বলেন, তাঁর কারণে বিভাগের অধ্যক্ষ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর বিব্রত হোন, তা তিনি চান না। তিনি পদত্যাগপত্র দাখিল করেন। তারপরও বিষয়টা নিয়ে মৃদু প্রতিবাদ করার তাগাদা অনুভব করেন তিনি। তার ফলেই শেলী’জ ওন শপ।’ (আনিসুজ্জামান, স্মরণ ও বরণ, ২০১৮)

যথাশব্দ-এর প্রণেতা

এরপর দেশে-বিদেশে ইতিহাসের পাশাপাশি আইনশাস্ত্রে পাঠ, অক্সফোর্ডের ডিগ্রি নিয়ে ১৯৫৯ সালে লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি; সিরাজগঞ্জ কলেজ, জগন্নাথ কলেজ, ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস ও আইন বিভাগে অধ্যাপনা এবং ১৯৬৪ সালে ঢাকা হাইকোর্ট বারে যোগ দেওয়া।

কোনো মাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রথম প্রবন্ধের বিষয় ছিল ভাষা। বাংলা ১৩৫৯ সংখ্যা সওগাত-এ কবি হাসান হাফিজুর রহমানের অনুরোধে লিখলেন য়ুরোপীয় রাজনীতি ও ভাষা সমস্যা।

১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি প্রকাশ করে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান প্রণীত বাংলা ভাষার প্রথম ভাব-অভিধান যথাশব্দ। ১৯৭৬ সালে কলকাতায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর বার্ষিক সম্মিলনীর সভাপতির ভাষণে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘বাঙ্গলা ভাষা, শব্দকোষ, সাহিত্য প্রভৃতি সব দিকেই বহু অনুসন্ধান ও গবেষণা হইয়াছে, ভালো অভিধানও বাহির হইয়াছে এবং আরও হইতেছে। কিন্তু ইংরেজি Roget's Thesaurus-এর মত বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক বিচারশৈলী অনুসারে, বিভিন্ন প্রকারের দ্যোতনার শব্দের বিশেষ কার্য্যকর অভিধান ছিল না। বাঙ্গালি সাহিত্যিক ও সাহিত্যরসিকের পক্ষে “যথাশব্দ” অভিধানখানি এইরূপ একখানি অপরিহার্য্য পুস্তকরূপে এখন দেখা দিল।’

একগুচ্ছ অভিধান ও কোষগ্রন্থ

১৯৭৬ সালের ১২ মে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। এর মধ্যেও চলে লেখালেখি ও গবেষণা। আর তার কেন্দ্রে থাকে বিচিত্র অভিধান ও বিশ্বকোষ রচনা।

২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি হলে যে কজন ছাত্র ফজলুল হক হলের পুকুরপাড়ে বসে গভীর রাতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে মত দেন, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ছিলেন তাঁদের অন্যতম।

১৯৮৪ সালে বচন ও প্রবচন-এর বছর পনেরো পর ২০০০ সালে মিত্রাক্ষর বাংলা ভাষার প্রথম অন্ত্যমিল শব্দকোষ। দেশের প্রধান বিচারপতি (১৯৯৫) ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার (৩০ মার্চ-২৩ জুন ১৯৯৬) দায়িত্ব পালন করেও তাঁর কর্তব্যের অবসান হয়নি। তাঁর এ-জাতীয় কাজের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন কোরানসূত্র (১৯৮৪) এবং যার যা ধর্ম: বাংলা ভাষায় প্রথম ধর্ম অভিধান (২০০৭, পরিমার্জিত সংস্করণ: প্রথমা প্রকাশন)। এই দুই গবেষণাকর্মের মধ্য দিয়ে তিনি মানুষের কাছে ধর্মের মর্মবাণী মাতৃভাষা বাংলায় পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেছেন। কোরআন শরিফে উল্লেখিত বিষয়ের বর্ণনানুক্রমিক বিন্যাস তিনি করেছেন কোরানসূত্রতে। আর কোরানশরিফ: সরল বঙ্গানুবাদ-এ (২০০০, নতুন সংস্করণ: প্রথমা প্রকাশন) মূলানুগ ও পূর্ণাঙ্গ বাংলা ভাষ্যে গিরিশচন্দ্র সেন, মোহাম্মদ আকরম খাঁ, আবুল ফজল বা কাজী আবদুল ওদুদের কোরআন অনুবাদের পরম্পরায় মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান রেখেছেন প্রাঞ্জলতার স্বাক্ষর। বাংলাদেশের সংবিধানের শব্দ ও খণ্ডবাক্য (১৯৯৭)-এর পর আনিসুজ্জামানের সঙ্গে প্রণয়ন করেন আইন-শব্দকোষ (২০০৬)।

রবীন্দ্রনাথ, মাতৃভাষা ও সকল ভাষার প্রেমিক

রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের প্রথম বইটি ভাষাকেন্দ্রিক, ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত মাতৃভাষার সপক্ষে রবীন্দ্রনাথ। আমরা কি যাবো না তাদের কাছে যারা শুধু বাংলায় কথা বলে, বাংলা ভাষার সংগ্রাম এখনও অসমাপ্ত, প্রথমে মাতৃভাষা, পরভাষা পরে, বাংলার সূর্য আজ আর অস্ত যায় না—বইয়ের এই শিরোনামগুলোই বলে দিচ্ছে, বাংলা ভাষার জন্য তাঁর ভালোবাসা ছিল অনিঃশেষ।

রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে কারাবাসের দায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের সদ্যনিযুক্ত প্রভাষক মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নিয়োগ বাতিল হয়ে গেছে। তিনি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিংহদ্বারে বুকে ট্রে ঝুলিয়ে সিগারেট বিক্রি করছেন এবং এই চলমান দোকানের নাম দিয়েছেন শেলী’জ ওন শপ।

তবে ভাষার প্রতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের ভালোবাসা যে সংকীর্ণ ছিল না, তার প্রমাণ ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত তাঁর বই একুশে ফেব্রুয়ারি সকল ভাষার কথা কয়। ২০১১ সালে আমরা তাঁর কাছ থেকে পেলাম টোয়েন্টি ফার্স্ট ফেব্রুয়ারি স্পিকস ফর অল ল্যাঙ্গুয়েজেস (বাংলা একাডেমি) বইটি। তাতে সংকলিত হলো বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় মাতৃভাষা নিয়ে লেখা কবিতার অনন্য এক সংকলন। আবদুল হাকিম আর ঈশ্বর গুপ্তের সঙ্গে সেখানে ঠাঁই করে নিলেন রুমি, রসুল গামজাতভ, কার্ল স্যান্ডবার্গ, ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, মাহমুদ দারবিশ, আন্না আখমাতোভা ও নিজার কাব্বানির মতো নানা কালের ও ভূগোলের কবি। এরই আরেক সম্পূরক বই দেশে দেশে ভাষা ও মাতৃভাষার কবিতা প্রকাশ পায় তাঁর প্রয়াণের পর।

বহুভাষাপ্রীতি থেকেই জীবনের গোধূলিবেলায় তিনি শিখতে শুরু করলেন চীনা ভাষা। অনুবাদ করলেন মূল চীনা ভাষা থেকে।

বহুভাষাপ্রীতি থেকেই জীবনের গোধূলিবেলায় তিনি শিখতে শুরু করলেন চীনা ভাষা। অনুবাদ করলেন মূল চীনা ভাষা থেকে।

মৃত্যু এসে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের এসব ইচ্ছার যতি টেনে দিলেও উত্তর প্রজন্মের কাছে তাঁর স্বপ্ন বেঁচে আছে কর্মে। আনিসুজ্জামানের কথায়, তিনি তেমন একজন মানুষ, ‘মাতৃভাষাকে ভালোবেসে অন্য ভাষার মর্যাদা দিতে যিনি ছিলেন অকুণ্ঠ। নিজ ধর্মে নিষ্ঠ হয়েও অন্য ধর্মের বিষয়ে ছিলেন বদান্য। বাংলাদেশকে স্বদেশ জেনেও যিনি ছিলেন বিশ্বনাগরিক।’