নিরাপত্তার ঘেরাটোপে বিরোধীদের প্রচার

যমুনাপারের সিরাজগঞ্জ শহরের বুক যেন লেপ্টে গেছে পোস্টারে পোস্টারে। আছে কান ঝালাপালা করা মাইকের আওয়াজ। সন্ধ্যা নামতে না-নামতেই শান্ত জনপদের অলিগলি থেকে বেরিয়ে আসছে নির্বাচনী মিছিল। তবে এসব পোস্টার, মাইক ও মিছিল কেবলই একটি দল—আওয়ামী লীগের। বিরোধী অন্য দল বা ব্যক্তির তেমন কোনো পোস্টার, মাইক বা মিছিল নেই শহরের কোথাও।

শহরে তাহলে কি আর কোনো দল নির্বাচন করছে না? তাদের পোস্টার, মাইক, মিছিল নেই কেন? গত রোববার সিরাজগঞ্জ-২ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও দলের জেলার ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হাবিবে মিল্লাতের কাছে এ প্রশ্ন করতেই তিনি বললেন, ‘আরে ভাই পোস্টার লাগাতে হলে তো সেটা ছাপতে হবে। এরা তো পোস্টারই ছাপেনি।’

কিন্তু আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, তাঁর লোকদের বাধা দেওয়া হয়েছে, তাঁদের ভয় দেখানো হচ্ছে। হাবিবে মিল্লাত বলেন, ‘এসব কথা ঘরে বসে বলছে কেন, রাস্তায় এসে বলতে বলেন। কেউ হুমকি দিলে তার তো প্রমাণ লাগবে। এসব রাজনৈতিক কথাবার্তা। আমি ভাই ডাক্তার মানুষ এসব বলতে পারব না।’

হাবিবে মিল্লাতের এস এস রোডের সুরম্য বাড়িটি ততক্ষণে নেতা-কর্মীতে ভরে গেছে। গাড়িবারান্দায় তিনটি জিপগাড়ি প্রস্তুত করা। তিনি জনসংযোগে বের হবেন। সবাইকে প্রস্তুত হতে বলে হাতের ফোন দেখিয়ে বললেন, ‘দিনে ২০ কিলোমিটার হাঁটছি, এই দ্যাখেন ফোনের রেকর্ড।’

হাবিবে মিল্লাতের বাড়ির সামান্য দূরে হোসেনপুরের আল মাহমুদ অ্যাভিনিউয়ে বিএনপির সাবেক মন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর বাড়ি। তাঁর স্ত্রী রুমানা মাহমুদ বিএনপির প্রার্থী। বিশাল প্রাচীরঘেরা জমিদারি ঢঙের পুরোনো বাড়িটি একেবারেই ফাঁকা। আঙিনার ভেতরের পুকুরপাড়ে দেখা গেল তিন যুবক বসে গল্প করছেন। সাংবাদিক পরিচয় দিতেই তাঁরা নিয়ে গেলেন বাড়ির ভেতরে রুমানা মাহমুদের কাছে। সারা দিন তিনি বাড়িতেই ছিলেন, কোথাও বের হননি।

নির্বাচনী প্রচার ছেড়ে বাড়িতে কেন? প্রশ্ন করতেই রুমানা বললেন, ‘বের হলেই তো আমার ছেলেদের ওপর হামলা হচ্ছে, তাদের মারপিট করা হচ্ছে। কালই (শনিবার) এ ঘটনা ঘটেছে। আমরা কেউ বেরই হতে পারছি না। এখন কোথাও গেলে আগে পুলিশ প্রশাসনকে জানাতে হচ্ছে। তারা পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।’ জেলা বিএনপির সভাপতি রুমানা মাহমুদ জানালেন, তাঁর মেয়ের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতা শেখ সেলিমের ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। সেই সুবাদে ব্যক্তিগতভাবে তিনি হয়তো রেহাই পাচ্ছেন।

এ অবস্থা শুধু একটি আসনের নয়, কমবেশি প্রায় সব আসনেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের সিরাজগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক হেলাল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চাই ভয়মুক্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। যাতে সবাই নিশ্চিন্তে ভোট দিতে পারেন। সেই পরিবেশের ঘাটতি আছে বলে মনে হচ্ছে।’

প্রায় ২২ লাখ ভোটারের এই জেলায় সংসদীয় আসন ছয়টি। এসব আসনে যাঁরা প্রার্থী হয়েছেন, তাঁদের প্রায় সবাই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। এর মধ্যেসিরাজগঞ্জ-১ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী দুঁদে রাজনীতিক, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম; তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী সংগীত শিল্পী রুমানা মোর্শেদ কনকচাঁপা। সিরাজগঞ্জ-২ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী হাবিবে মিল্লাতের শ্বশুর স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন। সিরাজগঞ্জ-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুল আজিজ ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক। বিএনপির প্রার্থী আবদুল মান্নান তালুকদার। সিরাজগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তানভীর ইমামের বাবা প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম। আর ধানের শীষ নিয়ে লড়ছেন জামায়াতের নেতা রফিকুল ইসলাম খান। সিরাজগঞ্জ-৫ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুল মমিন মণ্ডল। তিনি বর্তমান সাংসদ আবদুল মজিদ মণ্ডলের ছেলে। আর বিএনপির প্রার্থী কেন্দ্রীয় কমিটির সহপ্রচার সম্পাদক আমিরুল ইসলাম খান। আবারসিরাজগঞ্জ-৬আসনে বিএনপির প্রার্থী এম এ মুহিত। তিনি এইচ এম এরশাদের আমলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. এম এ মতিনের ছেলে। এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান সাংসদ হাসিবুর রহমান স্বপন। তিনি সাবেক উপমন্ত্রী।

এলাকার ভোটাররা বললেন, আওয়ামী লীগের ‘হেভিওয়েট’ প্রার্থীদের জেতাতে আড়ালে-আবডালে নানা তৎপরতা চলছে। আর সে কারণেই বিএনপির কর্মীরা মাঠে নামতে পারছেন না।

 বাধা ও হুমকির অভিযোগ

সিরাজগঞ্জ-১ আসনে বিএনপির প্রার্থী রুমানা মোর্শেদ কনকচাঁপা অভিযোগ করেন, ফোনে এবং বিভিন্নভাবে তাঁর নেতা-কর্মীদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এসব বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেছেন, কিছু ঘটলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, তাঁদের নির্বাচনী এলাকায় প্রচারণার জন্য গেলে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এখন জনসংযোগের আগে তিনি পুলিশকে জানিয়ে দিচ্ছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলার পরই বের হচ্ছেন।

একই অভিযোগ করলেন সিরাজগঞ্জ-৩ আসনের বিএনপির প্রার্থী আবদুল মান্নান তালুকদার। তিনি বলেন, ‘নানাভাবে বিএনপির কর্মীদের ভয় দেখানো হচ্ছে। কাউকে নামতে দেওয়া হচ্ছে না। আগে পুলিশকে জানিয়েও নামতে পারছি না।’

সিরাজগঞ্জ-৫ আসনেরপ্রার্থী আমিরুল ইসলাম খান বললেন, ‘মাঠে নামলেই আওয়ামী লীগের কর্মীরা মারধর করছে। আমরা কোথায় যাচ্ছি তা আগে পুলিশকে জানিয়ে দিচ্ছি। তারপরও হামলা কমছে না। পুলিশকে জানাচ্ছি, তারা কিছু করছে না।’ তবে সেনাবাহিনী মাঠে নামলে পরিস্থিতি বদলাতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হওয়ার পর সিরাজগঞ্জ-৬ আসনে বিএনপির প্রার্থী এম এ মুহিতের নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন সবচেয়ে বেশি। মুহিত বললেন, পরিস্থিতি নিয়ে তিনি সংবাদ সম্মেলনও করেছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি।

জানতে চাইলে সিরাজগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার টুটুল চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, ‘অভিযোগ আসছে রিটার্নিং অফিসারের কাছে।এরপর তাঁদের কাছ থেকে আমরা যেসব অভিযোগ পাচ্ছি, তার তদন্ত করছি। দরকারমতো ব্যবস্থাও নিচ্ছি।’

জেলা প্রশাসক ও জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা কামরুন নাহার সিদ্দীকা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি সবার অভিযোগ পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দিচ্ছি। কিন্তু তারা কী করছে, তা আমাকে জানাচ্ছে না, পুলিশও না। নির্বাচনী কর্মকর্তারা নাকি নির্বাচন কমিশনকেই সব জানাচ্ছেন। এতে করে আমি আসলেই বুঝতে পারছি না কী হচ্ছে।’