নির্জন প্রকোষ্ঠে ১৭০০ ফাঁসির আসামি

রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলার মামলায় ১৮ বছর আগে বিচারিক আদালত জঙ্গিনেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ (অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর) আট আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন। সেই মামলার ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও আপিল এখনো উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। একইভাবে আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় বিচারিক আদালত ১৪ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন পাঁচ বছর আগে। সেটাও এখনো হাইকোর্টের অনুমোদনের অপেক্ষায়।

এ রকম বিভিন্ন মামলায় মৃত্যুদণ্ডের সাজাপ্রাপ্ত ১ হাজার ৭০৪ আসামি কারাগারের কনডেম সেলে (নির্জন প্রকোষ্ঠে) চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষায় রয়েছেন। তাঁদের অনেকের মামলা হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্সের শুনানি চলছে। আবার অনেকের ডেথ রেফারেন্স শেষ হওয়ার পর আপিল করেছেন। সেটা আপিল বিভাগে বিচারাধীন।

উচ্চ আদালতে থাকা এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আইন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ ব্যাপারে গত বুধবার আইন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চিঠিতে বলা হয়েছে, গত ৩০ জুন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত কয়েদির মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে অনিষ্পন্ন ১ হাজার ৪৬৭টি মামলা এবং সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে ২৩৭টি মামলা। এসব মামলা ৬ মাস থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত বিচারাধীন রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ২০১৫ সালের মে মাস থেকে ২০১৯ সালের মে মাস পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ৪৮ জনের আপিল নিষ্পত্তি করা হয়েছে। আইনে ডেথ রেফারেন্স কত দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে, তার বাঁধাধরা নিয়ম নেই। তবে পেপারবুক তৈরির পর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিশু রাজীব হত্যা ও রাজন হত্যা মামলা, সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তা খালাফ আল আলী হত্যা, নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুন মামলা ও পিলখানা হত্যা মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে।

কারা কর্মকর্তাদের মতে, পেপারবুক তৈরিতে দেরি হওয়ায় ডেথ রেফারেন্স বছরের পর বছর ঝুলে থাকে। বছরের পর বছর ধরে এসব মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় আসামি ও বিচারপ্রার্থীরা হতাশায় দিন কাটান। মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হওয়া এসব আসামিকে দীর্ঘদিন কনডেম সেলে রাখার ফলে তাঁরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। আবার এই বিপুলসংখ্যক আসামির জন্য অর্ধেকের বেশি কারারক্ষীকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। ফলে তাঁরা অন্য আসামিদের দেখাশোনা করতে পারেন না। আবার কোনো কোনো মামলার ক্ষেত্রে বিচারিক আদালতের দেওয়া সাজা উচ্চ আদালত কমে যেতেও পারে। তাই যত দ্রুত সম্ভব ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি হওয়া উচিত।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ফাঁসির আসামিরা কেমন করুণ জীবন যাপন করেন, সেটা সরকার অনুধাবন করে না বলেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তিনি বলেন, নিম্ন আদালতে প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন মামলায় ফাঁসির রায় হচ্ছে। ফাঁসির এসব মামলা পরিচালনা করার জন্য অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিচারপতিও কম। এখন অস্থায়ী (অ্যাডহক) ভিত্তিতে অভিজ্ঞ বিচারক নিয়োগ করে এ সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে।

>উচ্চ আদালতে থাকা এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আইন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ ব্যাপারে গত বুধবার আইন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘উচ্চ আদালতে চলমান ডেথ রেফারেন্স এবং আপিল মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য প্রয়োজনীয় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আমরা আইন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছি। বিষয়টি আমরা তদারকি করছি। এ ছাড়া ডেথ রেফারেন্স মামলার বিষয়ে আইন ও বিচার বিভাগের সংশ্লিষ্টদের নিয়ে প্রতি মাসেই সভা করা হয়। ১০ বছরের ওপরে যেসব মামলা শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে, ওই সব মামলার বিশেষ শুনানির উদ্যোগ গ্রহণ করতে বলা হয়েছে।’

বিচারিক আদালতে দেওয়া মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হলে হাইকোর্ট বিভাগের অনুমোদন নিতে হয়। যা ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) হিসেবে পরিচিত। হাইকোর্টের রায়ের পর সংক্ষুব্ধ পক্ষ আপিল বিভাগে আপিল করতে পারে। আর আপিলে আসা সিদ্ধান্তের পর তা পুনর্বিবেচনা চেয়ে সংক্ষুব্ধ পক্ষের আবেদনও করার সুযোগ আছে। ডেথ রেফারেন্স শুনানির পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে পেপারবুক তৈরি করতে হয়, যেখানে মামলার এজাহার, অভিযোগপত্র, সাক্ষীদের বক্তব্য, বিচারিক আদালতের রায়সহ মামলার তথ্যাদি সন্নিবেশিত থাকে।

এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির করতে রাষ্ট্রপক্ষ কী করছে, জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব সাজাপ্রাপ্ত আসামির জন্য যে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, আমরা নিচ্ছি। আমরা চাই মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া সব আসামির সাজা দ্রুত কার্যকর হোক। ইতিমধ্যে বেশ কিছু মামলায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক তৈরির পর ডেথ রেফারেন্সের শুনানি ও নিষ্পত্তি হয়েছে।’

ডেথ রেফারেন্সে আলোচিত মামলা
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় বোমা পুঁতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে করা মামলায় ২০১৭ সালের ২০ আগস্ট ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২-এর বিচারক ১০ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। ২০০০ সালের ২০ জুলাই শেখ হাসিনার ভাষণের জন্য মঞ্চ নির্মাণের সময় মাটিতে পুঁতে রাখা ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পাওয়া যায়। পরদিন সেখানে তাঁর ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল। ঘটনার প্রায় ১৭ বছর পর নিম্ন আদালতের রায়ের পর হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শুরু হয়েছে।

২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনা বটমূলে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে জঙ্গি হামলায় নিহত হন ১০ জন। প্রায় পাঁচ বছর আগে এ মামলার রায়ে আট জঙ্গির ফাঁসি আর ছয়জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন বিচারিক আদালত। হত্যা মামলাটি এখন হাইকোর্টে বিচারাধীন। ডেথ রেফারেন্স ও জেল আপিল শুনানি পর্যায়ে। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের লিংক রোডের লামাপাড়া এলাকায় র‌্যাবের সদস্যরা চেকপোস্ট বসিয়ে কাউন্সিলর নজরুলের গাড়ি থামান। র‌্যাব গাড়ি থেকে নজরুল, তাঁর তিন সহযোগী ও গাড়িচালককে তুলে নিয়ে যায়। এ সময়ে ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন আইনজীবী চন্দন সরকার। তিনি অপহরণের বিষয়টি দেখে ফেলায় তাঁকে ও তাঁর গাড়িচালককেও র‌্যাব তুলে নিয়ে যায়। পরে তাঁদের সবাইকে হত্যা করে ওই রাতেই পেট কেটে এবং ইটের বস্তা বেঁধে সবার লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ডুবিয়ে দেয়। ওই বছরের ৩০ এপ্রিল ছয়জন ও পরদিন একজনের লাশ ভেসে ওঠে। আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের মামলায় ২০১৬ সালের ১৬ জানুয়ারি নিম্ন আদালতের দেওয়া রায়ে ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও নয়জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়। আসামিদের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য আদেশ হাইকোর্টে আসে। এ ছাড়া দণ্ডাদেশের রায়ের বিরুদ্ধে ২৮ আসামি হাইকোর্টে আপিল করেন। আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে হাইকোর্ট ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় দেন। হাইকোর্টের রায়ে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া ১১ আসামির দণ্ড পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। গত বছরের ১৯ নভেম্বর হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে। রায়ের পর আসামিরা সুপ্রিম কোর্টের আপিল শাখায় আপিল করেন। বর্তমানে আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।