নির্দেশনা আছে, তবে তথ্য প্রকাশের তাগিদ নেই

অনেক ওয়েবসাইট পুরোনো তথ্যে ভরা। দ্রুত হালনাগাদ করা হয় শুধু মন্ত্রী, সচিব ও সংস্থাপ্রধানের তথ্য। অনেকে অবশ্য এগিয়ে।

বার্ষিক প্রতিবেদনটি সাত বছরের পুরোনো। মাসিক প্রতিবেদন অংশে কোনো কিছু নেই। নিজেদের অর্জনের ঘরটিও খালি। সর্বশেষ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিটি আট মাস আগের। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি আছে, তবে চুক্তির বাস্তবায়ন অগ্রগতি নিয়ে প্রতিবেদন অংশ একেবারেই খালি।

এ চিত্র সরকারি একটি সংস্থার ওয়েবসাইটের। সংস্থাটির নাম সমাজসেবা অধিদপ্তর, যেটি নিজেকে নিজেদের ওয়েবসাইটেই ডিজিটাল বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ দপ্তর বলে অভিহিত করেছে।

হালনাগাদ তথ্য ও প্রতিবেদন না থাকলেও ওয়েবসাইটটির ডান পাশে দৃষ্টিগ্রাহ্য স্থানে অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের ছবি ও জীবনবৃত্তান্ত রয়েছে। ওয়েবসাইটে মহাপরিচালক স্থানীয় প্রশাসনে কাজ করার সময় তাঁকে ও তাঁর উদ্যোগ নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত পুরোনো প্রতিবেদনও তুলে ধরা হয়েছে।

ওয়েবসাইট কেন হালনাগাদ করা হয় না, তা জানতে চাইলে গতকাল বৃহস্পতিবার সমাজসেবা অধিদপ্তরের জনসংযোগ বিভাগের উপপরিচালক মোহাম্মদ রেজাউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি সম্প্রতি যোগ দিয়েছেন। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের মতো সরকারি অনেক সংস্থার ওয়েবসাইট হালনাগাদ করা নেই। বিগত এক মাসে সরকারি ৪০টি সংস্থার ওয়েবসাইট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০টির বেশি সাইটে বার্ষিক প্রতিবেদন পুরোনো। বেশির ভাগের প্রকাশনার ঘর থাকে ফাঁকা বা পুরোনো তথ্যে ভরা। গবেষণা, প্রকল্প ও অন্যান্য বিষয়েও অনেক ক্ষেত্রেই তথ্য পাওয়া যায় না। অনেক কিছুই হালনাগাদ বা আপডেট করা হয় না। যদিও তথ্য প্রকাশে তথ্য কমিশন ও সরকারের নির্দেশনা রয়েছে। তবে প্রতিটি সাইটে মন্ত্রী, সচিব ও সংস্থাপ্রধানের হালনাগাদ তথ্য রয়েছে।

* জাতিসংঘের ই-গভর্নমেন্ট সূচকে ১১৫তম বাংলাদেশ। * প্রতিবছর তথ্য প্রকাশের বিষয়ে তথ্য কমিশনে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা। অনেকেই দেয় না।

সরকারের সব ওয়েবসাইট তৈরির কাজ করেছে এটুআই (সাবেক অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন প্রকল্প)। তাদের হিসাবে সরকারি ওয়েবসাইটের সংখ্যা ৩৩ হাজার ২৯৬ এবং সংযুক্ত অফিসের সংখ্যা ৫১ হাজার ৫১২টি। এটুআইয়ের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আরফে এলাহী প্রথম আলোকে বলেন, ওয়েবসাইট হালনাগাদ করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সংস্থার।

সরকারি সংস্থার ওয়েবসাইট হালনাগাদ না করা জাতিসংঘের ই-গভর্নমেন্ট জরিপে বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকার একটি কারণ। জাতিসংঘ যে তিনটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে জরিপটি করে, যার একটি হলো অনলাইনে সেবা ও তথ্য দেওয়া। ২০২০ সালের ই-গভর্নমেন্ট জরিপে বাংলাদেশ ১৯৩টি দেশের মধ্যে চার ধাপ পিছিয়ে ১১৫তম অবস্থানে নেমেছে।

হালনাগাদে পিছিয়ে যারা

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে বার্ষিক প্রতিবেদনটি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের। এরপর পেরিয়ে গেছে দুই অর্থবছর। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে করোনার সময়ে পাঠদান বিষয়ে কোনো নির্দেশিকার তথ্য পাওয়া যায়নি। সাইটে ‘ঘরে বসে শিখি’ নামে একটি অপশন আছে, যেখানে ক্লিক করলে একই নামের ইউটিউব চ্যানেলে নিয়ে যায়। সেই চ্যানেলে সর্বশেষ আধেয় (কনটেন্ট) সাত মাস আগে তোলা।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগে ১০ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। বিভাগটির পরিচালক মো. বদিয়ার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সাইটের সব তথ্য হালনাগাদ থাকা উচিত। যেখানে ঘাটতি আছে, দ্রুতই তা ঠিক করা হবে।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ওয়েবসাইটে কোনো বার্ষিক প্রতিবেদন নেই। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের পর আর কোনো বাজেটের তথ্যও নেই। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের হালনাগাদ বার্ষিক প্রতিবেদনও তাদের ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়নি।

জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা তথ্য বাতায়ন সাইটটিতে বলতে গেলে কিছুই নেই। গত এপ্রিল মাসে জয়িতা ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে ভার্চ্যুয়াল শপে ক্লিক করলে চীনা ভাষার একটি সাইটে নিয়ে যেত। এখন ক্লিক করলে পাওয়া যায় ‘ইজয়িতাডটকম’, তবে সাইটটি ‘লোড’ হয় না। তাদের সর্বশেষ প্রকাশনা ২০১৮ সালের। কোনো বার্ষিক প্রতিবেদন নেই।

জুট করপোরেশনের সাইটে প্রকাশনা ও বার্ষিক প্রতিবেদন নেই। চলমান ও গুরুত্বপূর্ণ মামলার বিষয়ে ২০১৬ সালের তথ্য রয়েছে। এমনকি জুট করপোরেশনের কাজ, লক্ষ্য, উদ্দেশ্যে সম্পর্কেও ওয়েবসাইটে কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। এভাবে পিছিয়ে রয়েছে আরও অনেক সরকারি সংস্থার ওয়েবসাইট।

অনেক সংস্থা এগিয়ে

বেশ কিছু সরকারি সংস্থার ওয়েবসাইট নিয়মিত হালনাগাদ করা হয়। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের খাদ্যশস্য পরিস্থিতির নিয়মিত প্রতিবেদন পাওয়া যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো তাদের প্রতিবেদন নিয়মিত ওয়েবসাইটে তুলে ধরে।

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ওয়েবসাইটে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি পাওয়া যায়। কালো তালিকাভুক্ত ঠিকাদার কারা, সেটাও ওয়েবসাইটে দিয়ে রেখেছে তিতাস। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) ওয়েবসাইটে নিয়মিত প্রকল্প মূল্যায়ন প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়। আরও কিছু সরকারি সংস্থা নিয়মিত ওয়েবসাইট হালনাগাদ করে।

তথ্য প্রকাশে সরকারি নির্দেশনা

তথ্য অধিকার আইনে বলা হয়েছে, প্রত্যেক কর্তৃপক্ষ তাদের সিদ্ধান্ত, কার্যক্রম কিংবা সম্পাদিত বা প্রস্তাবিত কর্মকাণ্ডের সব তথ্য নাগরিকদের কাছে সহজলভ্য হয়, এমনভাবে সূচিবদ্ধ করে প্রকাশ ও প্রচার করবে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবালয় নির্দেশমালা ২০১৪-তেও সরকারি সংস্থার ওয়েবসাইটে হালনাগাদ তথ্য, প্রতিবেদন, বিজ্ঞপ্তি, অর্থ বরাদ্দ ও ব্যবহারসংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করতে বলা হয়েছে। এতে সরকারি ওয়েবসাইটগুলোকে তথ্যপ্রাপ্তির স্বীকৃত উৎস হিসেবেও বিবেচিত হবে বলে উল্লেখ করা হয়।

২০১৪ সালে তথ্য কমিশন থেকে স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশ নির্দেশিকা জারি করা হয়। এতে বলা হয়, কর্তৃপক্ষ কতটুকু তথ্য প্রকাশ করেছে, তার প্রতিবেদন প্রতিবছর কমিশনে পাঠাতে হবে।

তথ্য কমিশনের পরিচালক (গবেষণা, প্রকাশনা ও প্রশিক্ষণ) মো. আবদুল হাকিম প্রথম আলোকে বলেন, ওয়েবসাইট হালনাগাদে কিছুটা ঘাটতি আছে। এ বিষয়ে আরও জোর দিতে হবে। ওয়েবসাইট হালনাগাদের প্রতিবেদন পাঠানো হয় কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, কেউ পাঠায়, কেউ পাঠায় না। কমিশন বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে।