নির্ধারিত সময়ে শেষ হচ্ছে না

>

ঢাকা মহানগরে সরবরাহ করা পানির ৭০ ভাগ ভূগর্ভস্থ উৎসের পরিবর্তে ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে উৎপাদন করতে চায় ঢাকা ওয়াসা। এটি অর্জনে ২০২১ সাল পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করেছে সংস্থাটি। কিন্তু আগামী তিন বছরে এটি অর্জন নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রকল্পগুলোর ধীরগতির কারণে ব্যায়ের পরিমাণও বহু বেড়েছে। তবে ওয়াসার দাবি, তারা সঠিক পথেই এগোচ্ছে।

ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের মধ্যে ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে পানি উৎপাদনের লক্ষ্য অর্জন নির্ভর করছে চলমান চারটি প্রকল্পের ওপর। এর মধ্যে দুটি প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি। প্রকল্প দুটির ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৩১১ কোটি টাকা। আর বাকি দুই প্রকল্পও চলছে ঢিমেতালে। এর মধ্যে একটি প্রকল্পের গতি কচ্ছপকেও হার মানিয়েছে। বর্তমান গতিতে চললে এটি শেষ হতে ১৫০ বছর সময় লাগবে।

ওয়াসার তথ্য অনুযায়ী, সংস্থাটি এখন‍ দৈনিক ২৪৪ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করতে পারে। এর মধ্যে পাঁচটি শোধনাগারের মাধ্যমে ৪৯ কোটি লিটার পানি আসে ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে। আর বাকি পানি তোলা হয় ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলে বসানো ৮১০টি গভীর নলকূপের মাধ্যমে। শতকরা হিসাবে ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ প্রায় ৭৮ ভাগ।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, এটি কিছুতেই পরিবেশবান্ধব নয়। গভীর নলকূপের কারণে এলাকাভেদে প্রতিবছর এক থেকে দুই মিটার পর্যন্ত পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। এটি চলতে থাকলে আগামী দুই থেকে চার বছরের মধ্যে ভয়াবহ পানির সংকট দেখা দেবে। এ জন্য ভূ-উপরিস্থ পানির উৎসের দিকে যেতে হবে।

ঢাকা ওয়াসার পক্ষ থেকেও একাধিকবার ভূ-উপরিস্থ পানি শোধন করে ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। গত ২ এপ্রিল এক সংবাদ সম্মেলনে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বলেন, ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করতে পদ্মা-জশলদিয়া পানি শোধনাগার নির্মাণ প্রকল্প (ফেজ-১), সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার নির্মাণ প্রকল্প (ফেজ ৩), গন্ধর্বপুর পানি শোধনাগার প্রকল্প ও তেতুলঝড়া-ভাকুর্তা ওয়েলফিল্ড নির্মাণ প্রকল্পের (ফেজ-১) কাজ চলছে। তিনি আশা করেন, ২০২১ সাল নাগাদ এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হলে যে পানি আসবে, তার সঙ্গে চলমান পাঁচটি শোধনাগারের পানি যোগ হলে ওয়াসার উৎপাদিত পানির ৭০ ভাগই আসবে ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে।

ওয়াসার চলমান চার প্রকল্পের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পানি (দৈনিক ৫০ কোটি লিটার) আসার কথা গন্ধর্বপুর পানি শোধনাগার প্রকল্প থেকে। ২০১৪ সালে প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। শেষ হওয়ার কথা ২০২২ সালের জুন মাসে। গত ৪৫ মাসে এই প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ২০ শতাংশ। এই গতিতে চললে প্রকল্পটির নির্ধারিত মেয়াদে কাজ হবে মাত্র ৪১ শতাংশ।

পদ্মা-জশলদিয়া এবং সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার প্রকল্প (ফেজ-৩) দুটি থেকে দৈনিক ৪৫ কোটি লিটার করে ৯০ কোটি লিটার পানি শোধনের কথা।

তথ্য অধিকার আইনে করা এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওয়াসার দেওয়া তথ্য ও প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, পদ্মা-জশলদিয়া প্রকল্পটির প্রথম অনুমোদিত মেয়াদ ছিল ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত। এক দফা এর মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। গত মে মাস পর্যন্ত প্রকল্পটির অগ্রগতি মাত্র ৫৬ দশমিক ৯০ শতাংশ। প্রকল্পটির মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ৩ হাজার ৫০৮ কোটি ১৫ লাখ টাকা। প্রথম দফায় সংশোধন করে এই ব্যয় ৩ হাজার ৩৭৫ কোটি ১৭ লাখ (প্রায়) টাকা নির্ধারণ করা হয়। আবার এটি সংশোধন করে করা হয় ৩ হাজার ৬৭০ কোটি ৫০ লাখ টাকা (প্রায়)। দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে প্রকল্পটির ব্যয় প্রায় ২৯৫ কোটি টাকা বাড়ানো হয়।

ওয়াসার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সায়েদাবাদের (ফেজ-৩) প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়েছে ২০১৫ সালে। পাঁচ বছরে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু তিন বছরে প্রকল্পটির অগ্রগতি মাত্র ২ শতাংশ। এই গতিতে কাজ চললে প্রকল্পটির শতভাগ কাজ শেষ হতে ১৫০ বছর সময় লাগবে।

তেতুলঝড়া-ভাকুর্তা ওয়েলফিল্ড নির্মাণ প্রকল্পটির কাজ শুরু হয় ২০১২ সালের জুলাই মাসে। ২০১৬ সালে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। গত মে মাসে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানিয়েছিলেন, জুন (গত) মাস নাগাদ এই প্রকল্প থেকে দৈনিক ১৫ কোটি লিটার পানি মিরপুরে আসবে। এই প্রকল্পটি সম্পর্কে তথ্য অধিকার আইনে জানতে চাওয়া হলে ওয়াসা জানিয়েছে, প্রকল্পটির মেয়াদ ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। প্রকল্পটির ব্যয়ও বেড়েছে প্রায় ১৬ কোটি টাকা। গত ১৮ জুলাই পর্যন্ত প্রকল্পটির ৯৪ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।

চার প্রকল্পের হাল সম্পর্কে অবহিত হয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, এই গতিতে কাজ চললে ২০২১ সালের মধ্যে ৭০ শতাংশ পানি ভূ-উপরিস্থ উৎস পানি উৎপাদন অসম্ভব। নির্ধারিত মেয়াদে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে না পারাকে ওয়াসার অদক্ষতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানোর নতুন একটি ধারা তৈরি হয়েছে। কোন প্রকল্পে কত টাকা ও কত সময় লাগবে, তা কেন আগে থেকে নির্ধারণ করা যায় না? একটি প্রকল্পে এত অনিশ্চয়তা থাকবে কেন? প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় ওয়াসার অদক্ষতার কারণে এমন হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।

প্রকল্পগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বলেন, ‘প্রকল্পের মূল্যায়ন ও প্রকল্পের কাজ পরিচালনা দুটি ভিন্ন বিষয়। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমরা সঠিক পথেই আছি। যে গতিতে প্রকল্পের কাজ চলছে, সেভাবে চললেও ২০২১ সাল নাগাদ ৭০ ভাগ পানি ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে আসবে বলে তিনি দাবি করেন।’