
সাবেকুন্নাহার ইভা (২৪)। সাড়ে চার বছরের যমজ দুই ছেলেকে নিয়ে ছিল সংসার। ৪ জুন ইউনিয়ন পরিষদের ষষ্ঠ ধাপের নির্বাচনের দুই দিন পর ৬ জুন নিজ বাড়িতে স্বামী বিপ্লব প্রকাশ্যে ইভাকে হত্যা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বিপ্লব ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, ইভা তাঁর চাচাশ্বশুর শাহ আলম সরকারকে ভোট দেননি।
আদরের একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে ইভার বাবা-মা এবং বোনকে হারিয়ে তাঁর চার ভাই এখন পাগলপ্রায়। অবুঝ দুই সন্তান হাসান ও হোসেন খুঁজে ফেরে মাকে। হঠাৎ হঠাৎ বলে ওঠে, ‘মায়ের কাছে যাব।’
কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার আকবপুর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে ইভার চাচা শিমুল বিল্লাল চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। আর বিপ্লবের চাচা শাহ আলম সরকার বিএনপির প্রার্থী হিসেবে অংশ নেন। দুজনই হেরেছেন। তবে তাঁদের মধ্যে ভোট বেশি পেয়েছেন ইভার চাচা।
বাবা খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত এবং পলাতক। বাবা-মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত দুই সন্তান সাবিদ হাসান ও সোয়াব হোসেন। তাদের দিন কাটছে নানাবাড়িতে। তবে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ইভার বাবা সফিকুল আলম ও মা সায়েদা আক্তার।
সরেজমিনে গত বৃহস্পতিবার উপজেলার পীরকাশিমপুর গ্রামে ইভার বাবার বাড়িতে গিয়ে তাঁর বাবা-মা ও মামাদের সঙ্গে কথা হয়। ইভার মা বলেন, আগে নির্বাচন মানে উত্সব মনে হতো। এবারের নির্বাচন তাঁদের জন্য, ইভার দুই সন্তানের জন্য অভিশাপ হয়ে এসেছে।
ইভার পরিবারের সদস্যরা এই হত্যার বিচার চান। তবে অবুঝ শিশু দুটি খোঁজে মা-বাবাকে।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, বিপ্লবের বাসায় ভোটের হিসাব-নিকাশ নিয়ে ৬ জুন দুপুরে আলোচনা চলছিল। শাহ আলম ও পরিবারের অন্য সদস্যরাও সেখানে ছিলেন। একপর্যায়ে বিপ্লবের পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ তোলেন, ইভা চাচাশ্বশুরকে ভোট না দিয়ে নিজের চাচাকে ভোট দিয়েছেন। ইভা বলেন, তিনি চাচাশ্বশুরকে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু এই উত্তরে বিপ্লব সন্তুষ্ট হতে পারেননি। বিপ্লব ইভার গলা চেপে ধরে ঘরের দেয়ালে মাথা ঠুকে দেন। ইভা দৌড়ে নিজের ঘরে ঢুকলে শাহ আলম ও বিপ্লব দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলেন। এরপর আরও কয়েকবার মাথার পেছনের অংশ দেয়ালে ঠোকেন। একপর্যায়ে রক্ত পড়া শুরু হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের সূত্রে জানা গেছে, বিপ্লব ইভাকে নবীনগরে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য বের হন। একটি টেম্পোকে দাঁড় করিয়ে অন্য যাত্রীদের নামিয়ে ইভাকে যখন নেওয়া হচ্ছিল, তখন পরিচিত দুজন নারী বিপ্লবের কাছে জানতে চান, ‘ইভার কী হয়েছে।’ বিপ্লব তাঁদের বলেন, ‘ইভা বিষ খেয়েছে।’ সেখানে উপস্থিত এক নারী বলেন, ‘বিপ্লব যখন বিষ খাওয়ার কথা বলেছে, তখন ইভা বলেছিল, “তুমি (বিপ্লব) তো আমাকে মারলে। আমি বাঁচব তো”।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই নারী স্থানীয় লোকজন ও পুলিশকে বিষয়টি জানিয়েছিলেন বলেও দাবি করেন।
সায়েদা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষ খেলে কেন রক্ত বের হবে। এরপর মেয়ের মুখের কাছে নাক নিয়ে শুঁকলাম। দেখি, বিষের কোনো গন্ধ নেই। ফেনা নেই।’
বিপ্লবের ফুফা মো. শাহজাহান থানায় অপমৃত্যুর মামলা করতে গেলে তাঁর কথাবার্তায় সন্দেহ হয় পুলিশের। এরপর বাঙ্গরা বাজার থানার পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। মামলার বাকি সাত আসামি স্বামী বিপ্লব, শাশুড়ি দীপ্তি বেগম, চাচাশ্বশুর শাহ আলম, ছোটন মিয়া ও আবদুল মোতালেব, চাচাতো বোন জেসি বেগম, ভাই মুন্না সরকার পলাতক আছেন।
ইভার শ্বশুর পুলিশ কনস্টেবল নূরে আলম চাকরির কারণে এখানে থাকেন না। বৃহস্পতিবার যখন ইভার বাসায় বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখন ফোন করেন নূরে আলম। প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলবেন কি না—জানতে চাইলে তিনি ইভার বাবাকে বলেন, ‘সাংবাদিকদের বলেন, আপনার বক্তব্যই আমার বক্তব্য। অপরাধী যে-ই হোক, শাস্তি পেতে হবে।’
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বাঙ্গরা বাজার থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নজরুল ইসলাম বলেন, এখনো ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আসেনি। প্রাথমিকভাবে হত্যা বলে মনে হয়েছে। একজন আসামি ধরা পড়েছে। বাকিদেরও ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে।
ইভার শ্বশুরবাড়িও একই গ্রামে। সেখানে গিয়ে এক বৃদ্ধা ছাড়া কাউকে পাওয়া যায়নি। তিনি বিপ্লবের দাদি বলে পরিচয় দিয়েছেন।