পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে পুলিশের চাঁদাবাজি

ঢাকা বা চট্টগ্রামের বাজারে যে এক কেজি বেগুন আপনি ৫০ টাকায় কিনলেন, বগুড়ার কৃষক সেই বেগুন খেত থেকে মহাস্থান হাটে বিক্রি করেছেন মাত্র চার থেকে পাঁচ টাকা। সব ধরনের সবজির ক্ষেত্রেই উৎপাদকেরা এ রকম দরই পাচ্ছেন।
দেশে সবজির একটি বড় উৎস বগুড়ার মহাস্থান হাট। বগুড়া শহরের ১২ কিলোমিটার উত্তরে রংপুর-ঢাকা মহাসড়কে অবস্থিত এই হাট থেকে ঢাকা বা চট্টগ্রামে আসতে আসতেই সব ধরনের সবজির দর বেড়ে যাচ্ছে ১০ থেকে ২০ গুণ পর্যন্ত। এর বড় কারণ পণ্য পরিবহনের পথে পথে চাঁদাবাজি। থানা বা হাইওয়ের যে পুলিশ পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে সব ধরনের নিরাপত্তা দেবে বলে দায়িত্ব পেয়েছে, চাঁদাবাজি তারাই বেশি করছে।
কৃষক সবজি উৎপাদন করে তা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে দেন। সেই সবজি কয়েক হাত ঘুরে চলে আসে দেশের বিভিন্ন খুচরা বাজারে। কয়েক দফা হাত বদলের কারণে এক দফা দাম বাড়ে। আরেক দফা দাম বাড়ে পণ্যটি পরিবহনের সময়।
হিসাবটা এ রকম—বগুড়ার মহাস্থান হাট থেকে চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারের দূরত্ব ৪৩৯ কিলোমিটার। এ জন্য ট্রাক ভাড়া দিতে হয় ৩০ হাজার টাকা। এর বাইরে দীর্ঘ এই মহাসড়কের পথে পথে পণ্যবাহী একটি ১০ টনের ট্রাককে চাঁদা দিতে হয় প্রায় সাড়ে ২২ হাজার টাকা। এর মধ্যে হাইওয়ে, ট্রাফিক ও থানা পুলিশকে চাঁদা দিতে হয় গড়ে সাত হাজার থেকে আট হাজার টাকা। মহাসড়কে ওজন স্টেশনে দিতে হয় গড়ে দুই থেকে তিন হাজার টাকা। অবশিষ্ট চাঁদা দিতে হয় মহাস্থান হাট কমিটি, ট্রাক বন্দোবস্তকারী সমিতি এবং কুলি-শ্রমিক ইউনিয়নকে।
ভরা মৌসুমে বগুড়ার মহাস্থান হাট ও পাশের নয়মাইল আড়ত থেকে প্রতিদিন গড়ে ১০০ ট্রাক সবজি নিয়ে যায় ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। প্রতিটি ট্রাকে সাড়ে ২২ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হলে বছরে গড় চাঁদাবাজির পরিমাণ হয় প্রায় ৮১ কোটি টাকা। এর মধ্যে পুলিশ একাই নেয় প্রায় ২৯ কোটি টাকা।
এই প্রতিবেদক গত ২১ জুলাই ১০ টনের একটি সবজি বহনকারী ট্রাকে করে বগুড়ার মহাস্থান হাট থেকে চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারে গেছেন। পুরোটা সময় ট্রাক চালকের পাশে বসে তিনি দেখেছেন পুলিশের চাঁদাবাজি। কোথায় কাকে কত টাকা দিতে হয়েছে তাও দেখেছেন তিনি।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিষয়টি অতি গুরুত্ব দিয়ে তদারকি করা হচ্ছে। অনিয়ম ও অপরাধ যে হবে না, তা নয়। শুধু প্রশাসনই নয়, দুর্বৃত্তদের চাঁদাবাজির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ থাকলে ভুক্তভোগীকে তিনি জেলা পুলিশ বা পুলিশ সদর দপ্তরে যোগাযোগ করতে বলেন। আইজিপি বলেন, সার্বিক অবস্থার বিবেচনায় নিলে চাঁদাবাজি পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে আছে।
মহাস্থান হাট সবজির পাইকারি ব্যবসায়ী জাহিদুল ইসলাম বলেন, গত বছরের এ সময় সবজিসহ ১০ টনের একটি ট্রাক চট্টগ্রামে পাঠাতে ভাড়াসহ খরচ হতো গড়ে ১৮ হাজার টাকা। এ বছর সেই ভাড়া বেড়ে হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। এর বাইরে পথে পথে দিতে হচ্ছে চাঁদা। এতে সব মিলিয়ে প্রতি কেজিতে খরচ বাড়ছে সাত টাকার ওপরে।
সবজির ট্রাকে চাঁদাবাজি হয়—এ কথা স্বীকার করেন পশ্চিমাঞ্চল হাইওয়ে পুলিশ সুপার ইসরাইল হাওলাদার। তবে নিজে এর দায় নেননি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘সবজির ট্রাক থেকে চাঁদাবাজি শুরু হয় মহাসড়কের সিরাজগঞ্জের কড্ডার মোড় থেকে। এই চাঁদাবাজির সঙ্গে পশ্চিমাঞ্চল হাইওয়ে পুলিশ জড়িত নয়। কারণ কড্ডার মোড় পর্যন্ত রাত্রীকালীন মহাসড়কের নিরাপত্তার বিষয়টি পশ্চিমাঞ্চল হাইওয়ে পুলিশ দেখলেও যানবাহন থামিয়ে কাগজপত্র তল্লাশি করে অন্য পুলিশ। চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটে থাকে কাগজপত্র তল্লাশির সময়ই।’
ট্রাকচালক মানিক হোসেন বলেন, ‘মহাসড়কে পথে পথে পুলিশ কৌশলে চাঁদাবাজি করে। চিহ্নিত স্থানগুলোতে ট্রাক পৌঁছার আগেই নির্দিষ্ট পরিমাণ চাঁদা পুলিশ বা সঙ্গে থাকা দালালের হাতে দিতে হয়। আগে থেকে টাকা না দিলে নানা অজুহাতে ট্রাক আটকায়, হয়রানি করে পুলিশ। পণ্য পচনশীল হওয়ায় পুলিশি ঝামেলা এড়াতে চাঁদা দিয়ে নিরাপদ থাকে সবাই।
দাম বেড়ে যাওয়ার উদাহরণ: ২১ জুলাই মহাস্থান হাটে প্রতিকেজি কাঁচা মরিচের দাম ছিল ৬০ টাকা। অথচ পরদিন সকালে চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারে সেই কাঁচা মরিচ পাইকারি বাজারে বিক্রি হয়েছে ৮০ টাকায় আর খুচরা পর্যায়ে ১৪০ টাকা।
মহাস্থান হাটে একই দিন বরবটির দাম ছিল প্রতিকেজি ১৫ টাকা। সেই বরবটি রিয়াজউদ্দিন বাজারে বিক্রি হয়েছে ৩৬ টাকা। বগুড়ায় গোল বেগুনের দাম ছিল প্রতিকেজি ১০ টাকা, আর রিয়াজউদ্দিন বাজারে ৬০ টাকা। ১০ টাকা কেজির লম্বা বেগুন চট্টগ্রামে গিয়ে হয়েছিল ৫৬ টাকা। একই ভাবে মহাস্থান হাটে আট থেকে ১০ টাকায় কেনা ছাঁচি লাউ চট্টগ্রামে বিক্রি হয়েছে ২৫ থেকে ৩৫ টাকায়। আবার মহাস্থান হাটের ১০ টাকা কেজির শসা বিক্রি হয়েছে ৪০ টাকা কেজি দরে।
২৫ জুলাইয়ের বাজার: মহাস্থান হাটে গত বৃহস্পতিবার এক কেজি কাঁচা মরিচ বিক্রি করে কৃষক পেয়েছেন মাত্র ৩২ টাকা। অথচ একই কাঁচা মরিচ ঢাকার কারওয়ান বাজার ও চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারে বিক্রি হয়েছে ১০০ টাকায়।
বৃহস্পতিবার মহাস্থান হাট ঘুরে দেখা গেছে, এখানে গোল বেগুন প্রতি কেজি চার টাকা, লম্বা বেগুন প্রতি কেজি পাঁচ টাকা, মুলা ১২ টাকা, করলা তিন টাকা, শসা প্রতি কেজি আট টাকা, ধনেপাতা ৫০ টাকা এবং বরবটি প্রতি কেজি ১০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়া পটোলের দাম ছিল প্রতি কেজি আাাড়াই টাকা, কাঁচা মরিচ ৩২ টাকা, ছাঁচি লাউ প্রতিটি গড়ে চার টাকা থেকে ১০ টাকা, ঢ্যাঁড়স প্রতি কেজি দুই টাকা, কাঁকরোল প্রতি কেজি পাঁচ টাকা, পেঁপে পাঁচ টাকা এবং চিচিঙ্গা প্রতি কেজি দুই টাকা।
অন্যদিকে চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারের কাঁচামালের আড়ত লাকি ট্রেডার্সের ব্যবস্থাপক রিপন কুমার সাহা প্রথম আলোকে জানান, বৃহস্পতিবার এই বাজারে খুচরা পর্যায়ে প্রতিকেজি কাঁচা মরিচ ১০০ টাকা, গোল বেগুন প্রতি কেজি ৬০ থেকে ৭০ টাকা, লম্বা বেগুন ৩৬ টাকা, মুলা ৪০ টাকা, ভালো মানের করলা প্রতি কেজি ৬০ টাকা, শসা ৩৬ টাকা, ধনেপাতা প্রতি কেজি ৩২০ টাকা, বরবটি ৩২ টাকা, পটল ২৪ টাকা, পেঁপে ১৬ টাকা, ছাঁচি লাউ প্রতিটি গড়ে ১৫ থেকে ২৫ টাকা, ঢ্যাঁড়স ৩২ টাকা, কাঁকরোল ২৪ টাক এবং চিচিঙ্গা প্রতি কেজি ১৬ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
বগুড়ার সঙ্গে চট্টগ্রামের বাজারের সবজির দামের বিশাল এই পার্থক্যের কারণ জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগরের রিয়াজউদ্দিন বাজারের কাঁচামাল আড়তদার কল্যাণ সমিতির সভাপতি হাজী আবুল বশর সওদাগর বলেন, সবজির ট্রাকে বেপরোয়া চাঁদাবাজির কারণেই পরিবহন খরচ অনেক বেড়ে যাচ্ছে।
ঢাকার বাজার: রোজার শুরুতেই সব ধরনের শাকসবজির দাম কেজিতে পাঁচ থেকে ১০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বিক্রেতারা। আর রোজার অর্ধেক পেরিয়ে গেলেও সেই দাম বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কমেনি।
রোজার শুরুতে এক কেজি বেগুনের দাম ৬০ টাকা উঠেছিল। তবে এখন তা কিছুটা কমে ৪৫ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কাঁচা মরিচের দাম কেজিপ্রতি ২০০ টাকা উঠলেও এখন তার দর ১০০ থেকে ১২০ টাকা। এ ছাড়া ভালো মানের এক কেজি শসার দাম এখন ৩৫ থেকে ৪০ টাকা।
ঢাকার কারওয়ান বাজারে কাকরোল, করলা, ঢ্যাঁড়স ও চিচিঙ্গা বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ টাকা কেজি দরে। পেঁপের দাম কেজিপ্রতি ২০ থেকে ২৫ টাকা। আর এক কেজি বরবটি ৪০ টাকা, পটোল ২০ থেকে ২৫ টাকায় বিক্রি করছেন বিক্রেতারা। মাঝারি আকারের লাউয়ের দাম ৫০ থেকে ৬০ টাকা।