পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় চাপে ২৯ শতাংশ মানুষ

১৭ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল শহর ও গ্রামাঞ্চলের ২ হাজার ৭৯টি খানার ওপর জরিপটি করা হয়।

ফাইল ছবি

করোনার কারণে দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের আয় কমে যায়। পাশাপাশি স্বাস্থ্যগত সংকটে পড়েন তাঁরা। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় তাঁরা ঘুরে দাঁড়াচ্ছিলেন। তবে পণ্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি নতুন করে বিপদ তৈরি করেছে। এতে এখন ২৯ শতাংশ মানুষের জীবনমান চাপে পড়েছে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছে, ছয় মাস আগে দেশের ১৮ শতাংশ মানুষের জীবনমানের ওপর চাপ ছিল। এখন সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দ্বিগুণের কাছাকাছি। বরিশাল, রাজশাহী ও বরেন্দ্র এলাকা এবং ঢাকা বিভাগের দরিদ্ররা সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থায় আছে।

বাংলাদেশের মানুষের ওপর করোনার প্রভাব ও দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি নিয়ে এফএওর করা এক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। জরিপের ফলাফল গত ৩০ মে প্রকাশ করা হয়।

এমন পটভূমিতে আজ ৭ জুন বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে খাদ্য সুরক্ষা দিবস পালিত হচ্ছে। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘নিরাপদ খাদ্য ও সুস্বাস্থ্য’।

গত ১৭ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত সারা দেশের শহর ও গ্রামাঞ্চলের ২ হাজার ৭৯টি খানার ওপর জরিপটি করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডির সহায়তায় একযোগে বিশ্বের ২৫টি দেশে জরিপটি পরিচালিত হয়েছে। এসব দেশের খাদ্যনিরাপত্তায় সরকারের উদ্যোগকে সহযোগিতা দিতে ২০০০ সাল থেকে জরিপটি নিয়মিতভাবে (বছরে দুটি) করছে তারা।

করোনার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে দ্রব্যমূল্য দ্রুত বাড়ছে। ফলে এর কিছু প্রভাব দেশের গরিব মানুষের ওপর পড়বে।
আব্দুর রাজ্জাক, কৃষিমন্ত্রী

এর আগে ২০২১ সালে করা জরিপে গবাদিপশুনির্ভর জনগোষ্ঠীর জীবনমানের ওপর বেশি চাপ পড়তে দেখা যায়। সর্বশেষ জরিপের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, দেশের অকৃষি খাতের সঙ্গে যুক্ত মানুষ অর্থাৎ ব্যবসায়ী ও পেশাজীবীরা খাদ্য নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন। এর কারণ হিসেবে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া ও কর্মসংস্থান কমে যাওয়াকে দায়ী করা হয়েছে। সেই সঙ্গে কৃষিপণ্যের বাণিজ্য থেকে আয় ও কৃষিশ্রমিকদের মজুরি কমার বিষয়টিও উঠে এসেছে জরিপে।

তারা নতুন কর্মসূচি নেওয়ার জন্য তালিকা করতেই এক বছর পার করে দিয়েছে। এভাবে চললে দেশের গরিব মানুষের পুষ্টি ও খাদ্যনিরাপত্তার সমস্যা দূর হবে না। তাঁদের কষ্ট ও সমস্যা আরও বাড়বে।
হোসেন জিল্লুর রহমান, নির্বাহী চেয়ারম্যান, পিপিআরসি

জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, করোনার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে দ্রব্যমূল্য দ্রুত বাড়ছে। ফলে এর কিছু প্রভাব দেশের গরিব মানুষের ওপর পড়বে। কিন্তু সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ও কৃষি খাতে প্রণোদনার মাধ্যমে দরিদ্র মানুষদের সহায়তা করছে। কর্মসূচিগুলো সামনের দিনে আরও বাড়ানো হবে।

ছয় মাস আগে করা জরিপে ১৩ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছিলেন, কৃষি খামারে তাঁদের কাজ কমেছে। সর্বশেষ জরিপে তা বেড়ে ৫০ শতাংশ হয়েছে। অকৃষি খাতের কর্মসংস্থান কমেছিল ১৬ শতাংশ খানায়—এবার তা বেড়ে হয়েছে ৪১ শতাংশ। আগের জরিপে প্রবাসী আয়ের ওপর চাপ বেড়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন ৫৬ শতাংশ মানুষ, এবার তা কমে ৩৭ শতাংশ হয়েছে।

সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, ছয় মাস আগের তুলনায় এখন ৮১ শতাংশ কৃষক একই পরিমাণ বা বেশি পরিমাণে ফসলের চাষ করেছেন। তবে এবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসলহানি, পোকা ও রোগের আক্রমণ, পানি ও সার–সংকট বেশি। ৮০ শতাংশ কৃষক মনে করছেন, এবার তাঁদের ফলন মাঝারি থেকে ভালোর মধ্যে থাকবে।

এফএওর প্রতিবেদনে দেশের পোলট্রি খাতের চিত্র তুলে ধরে বলা হয়েছে, ৭৪ শতাংশ গরু ও ৮০ শতাংশ মুরগির স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। কারণ, হিসেবে এদের খাবারের দাম বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করা হয়েছে। তবে মুরগি ও গরুর মাংসের দাম বেড়ে যাওয়ায় খামারিরা ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারছেন।

খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তার দিক থেকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় খুলনা বিভাগ। এই বিভাগের মানুষের মধ্যে নানা ধরনের পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার পরিমাণ কমেছে। ঢাকা, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের কৃষক পরিবারগুলোতে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার পরিমাণ অন্য বিভাগগুলোর তুলনায় কমেছে।

জরিপে অংশ নেওয়া ৬৮ শতাংশ পরিবার জরুরি ভিত্তিতে নগদ অর্থসহায়তা দরকার বলে জানিয়েছে। এর মধ্যে অকৃষি খাতের সঙ্গে যুক্ত ৮৪ শতাংশ পরিবার নগদ অর্থসহায়তা চেয়েছে।

ঢাকা ও রাজশাহী বিভাগের গবাদিপশু ও পোলট্রি খামারিদের তাঁদের পশুপাখির চিকিৎসাসেবা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। সিলেট, খুলনা ও চট্টগ্রাম বিভাগের গরিব মানুষের জীবিকার উন্নয়নে দ্রুত সহায়তা দেওয়া দরকার বলে জরিপে বলা হয়েছে।

এ ব্যাপারে বেসরকারি সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরাও গত মে মাসে দেশে জরিপ চালিয়ে প্রায় একই ধরনের চিত্র পেয়েছি। দরিদ্র মানুষের জীবনমানের ওপর আর্থিক ও সামাজিক চাপ বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে সরকার থেকে নানা উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু সরকার খোলাবাজারে চাল বিক্রি, গ্রামে ১০ টাকার ফেয়ার প্রাইস কমসূচি ও টিসিবির মাধ্যমে খাদ্যপণ্য বিক্রির মতো জনপ্রিয় কর্মসূচিগুলো বাড়াচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘তারা নতুন কর্মসূচি নেওয়ার জন্য তালিকা করতেই এক বছর পার করে দিয়েছে। এভাবে চললে দেশের গরিব মানুষের পুষ্টি ও খাদ্যনিরাপত্তার সমস্যা দূর হবে না। তাঁদের কষ্ট ও সমস্যা আরও বাড়বে।’