পথ দেখাল চোখের পানি

.
.

বাড়ির জন্য মন কাঁদে কিশোরটির। মন কাঁদে বাবা আর ভাইবোনদের জন্য। সেই কান্না ভেতরে আটকে থাকে না। চোখে চলে আসে যখন-তখন। তাতেই নজর পড়ে আশপাশের দরদি মানুষের। কিশোরটিকে বাড়ি পৌঁছে দিতে চান তাঁরা। কিন্তু বাড়ির ঠিকানা জানে না সে।
পাঁচ বছর আগে রাগ করে বাড়ি ছেড়েছিল সাহাবুদ্দিন। বয়স তখন নয় বছর। রিকশায় কিছু পথ এসে লঞ্চে উঠেছিল। তারপর ঘুম। ঘুম থেকে জেগে দেখল সে ঢাকায়। কীভাবে যেন কাজ জোটে হোটেলে। কেটে যায় পাঁচ বছর। সাহাবুদ্দিনের নাম বদলে হয়ে যায় রাসেল।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুপ্রাণবিজ্ঞানের (মাইক্রোবায়োলজি) চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ইমাম হোসেন। পুরান ঢাকার শ্যামবাজারে তাঁর বাবা আবদুল লতিফের দোকান। সেই দোকানের পাশেই সাদ্দাম হোটেলে কাজ করে রাসেল। আড়াই বছর আগে এক লোক তাকে এই হোটেলে দিয়ে যায়। ইদানীং সে কেবল বাড়ি যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করে। আবদুল লতিফকে সে নানা ডাকে। কিশোরটির চোখে প্রায়ই পানি দেখেন তিনি। তাই একদিন ছেলে ইমাম হোসেনকে বললেন রাসেলের পরিবারকে খুঁজে বের করতে।
কিন্তু রাসেল বাড়ির ঠিকানা বলতে পারে না। ইমামের মনে হলো, ছেলেটির ছবি যদি পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়, তাহলে হয়তো পরিবারের সদস্যরা দেখে তাকে চিনতে পারবেন। এমন ভাবনা থেকে ওকে নিয়ে এই প্রতিবেদকের কাছে আসেন ইমাম হোসেন।
ঢাকায় আসার গল্পটা মনে আছে রাসেলের। ‘রিকশায় করে কিছুদূর আইয়া ঘাট থেকে লঞ্চে উঠছি। তারপর ঘুমাইয়া গেছি। লঞ্চ থেকে নামার পর নদীর ধারের একটা হোটেলে গেছি। পরে ওটাতেই কাজ করছি।’ লঞ্চে কতক্ষণ লেগেছিল জানতে চাইলে রাসেল বলল, ‘দুই-তিন ঘণ্টা হইব।’

প্রথম আলোর অভ্যর্থনাকক্ষে ততক্ষণে রাসেলকে দেখতে ভিড় জমেছে। বাড়ি থেকে পালালে কেন জানতে চাইলে রাসেল কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, মা (শাহেদা আক্তার) মারা যাওয়ার পর বাবা (ফয়জুল হক) আরেকটা বিয়ে করেছেন। বাড়িতে তাকে মারধর করা হতো। তাই রাগ করে বাড়ি ছেড়েছে। এখন তাহলে বাড়ি যেতে চাইছ কেন? ‘বাবা-ভাইবোনদের কথা মনে পড়ে। একটু দেখতে চাই সবাইরে।’ রাসেল জবাব দেয়।

ইমাম হোসেন জানালেন, রাসেল নোয়াখালীর আঞ্চলিক টানে কথা বলে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। স্কুলের নাম বলছে, ইয়াছিন চেয়ারম্যানের স্কুল।

সার্চ ইঞ্জিন গুগলে খোঁজ নিয়ে এই নামে কোনো স্কুল পাওয়া গেল না? খোঁজখবর করে জানা গেল, নোয়াখালীর একমাত্র উপজেলা হাতিয়া, যেখান থেকে ঢাকায় সরাসরি লঞ্চ আসে। গুগলে এবার ‘হাতিয়ার ইয়াসিন চেয়ারম্যান’ লিখে সার্চ দিতেই প্রথম আলোর দুটি পুরোনো প্রতিবেদন বেরিয়ে আসে। সেই প্রতিবেদনে দেখা যায়, হাতিয়ার সোনাদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানের নাম ইয়াসিন আরাফাত।

ঢাকায় একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সাংবাদিক হাতিয়ার বাসিন্দা সাইফুদ্দিন রবিনের সহায়তায় ইয়াসিন চেয়ারম্যানের মুঠোফোন নম্বর জোগাড় করা হলো। কিন্তু ইয়াসিন চেয়ারম্যান জানালেন, তাঁর নামে কোনো স্কুল নেই। তবে বাড়ির পাশে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। নাম দক্ষিণ-পূর্ব মাইজচরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এলাকায় অনেকে একে ইয়াসিন চেয়ারম্যানের স্কুল বলে থাকে। এবার তাকে কিশোর রাসেলের বৃত্তান্ত, বাবা-মায়ের নাম বলা হলো। তিনি রাসেলের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। তাঁর এক প্রশ্নের জবাবে রাসেল জানাল, স্কুলের কাছে মাস্টার মসজিদ নামে একটা মসজিদ আছে।

ইয়াসিন চেয়ারম্যান এই প্রতিবেদককে জানালেন, স্কুল আর ওই মসজিদ কাছাকাছি। তার মানে, ছেলেটি বোধ হয় এই এলাকার। তিনি ছেলেটির বাবা-মায়ের খোঁজ করার প্রতিশ্রুতি দেন।

গত শুক্রবার রাত ১০টা। ইয়াসিন চেয়ারম্যানের ফোন এল। ছেলেটির বাবার সন্ধান পেয়েছেন। লঞ্চের সারেং ছিলেন। ছেলের শোকে পাগলপ্রায়। খুবই দরিদ্র পরিবার। এখন তিনি ছেলেকে নিতে ঢাকায় আসতে চান।

গত বুধবার সন্ধ্যা। কারওয়ান বাজারের প্রথম আলো কার্যালয়। বাবা তাঁর ১৪ বছরের কিশোর ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। কাঁদছে বাবার সঙ্গে আসা রাসেলের আরেক ভাই। এখানেই জানা গেল রাসেলের আসল নাম সাহাবুদ্দিন। ঢাকায় আসার পর কীভাবে যেন তার নাম রাসেল হয়ে গেছে।

সাহাবুদ্দিনের বাবা ফয়জুল হক কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘পাঁচ বছর আগে ছেলেটা হারায়ে যায়। ওর মা মারা যাওয়ার পর একদিন বাড়ি থেকে পালাইয়া যায়। বহু জায়গায় খুঁজছি। হাতিয়া, নোয়াখালী, চিটাগাং। দুই বছর খুঁজে আমি ধরে নিছি ছেলে নাই, মরি গেছে। হে যে ঢাকা আসতে পারে, আমরা স্বপ্নেও ভাবি নাই। আজকে ছেলেটারে দেইখা শান্তি পাইলাম।’

সাহাবুদ্দিনরা চার ভাই, তিন বোন। সাহাবুদ্দিনের পিঠাপিঠি বড় ভাই মনিরউদ্দিন বলে, সাহাবুদ্দিন হারানোর পর তার বাবা সারেংয়ের চাকরি ছেড়ে দেন। পাঁচ বছরেই বুড়ো হয়ে গেছেন বাবা। তেমন কথা বলেন না কারও সঙ্গে। কিন্তু সাহাবুদ্দিনকে দেখে যেন রাজ্যের শক্তি ফিরে এসেছে তাঁর গায়ে। হাসছেন, কথা বলছেন।

সেটা অবশ্য বৃদ্ধ ফয়জুল হককে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। একটু পরপর চোখ মুছছেন। আবার হাসছেন। সেই কান্না-হাসি দেখে আবেগাক্রান্ত ইমাম হোসেনও। তিনি বলেন, ‘আমার আট মাসের পরিশ্রম সার্থক হয়েছে। ছেলেটা আজ বাবার কাছে ফিরেছে। আমার কতটা ভালো লাগছে বুঝিয়ে বলতে পারব না।’

বাবাকে পেয়ে কেমন লাগছে জানতে চাইলে সাহাবুদ্দিন শরীর দুলিয়ে হাসতেই থাকল। আবার বাড়ি থেকে পালাবে কি না, জানতে চাইলে বলল, ‘আর কোনো দিন না।’

ঘণ্টাখানেকের কান্নাকাটি-কথাবার্তা শেষে প্রথম আলো ছাড়ার পালা পরিবারটির। বৃদ্ধ ফয়জুল হক ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আছেন। বাবা-ছেলের মুখে হাসি, চোখে পানি।