পদে পদে প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন লাকী

লাকী আক্তার
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

ছোটবেলা থেকেই পদে পদে প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু সেসব প্রতিবন্ধকতা একে একে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন লাকী আক্তার। তিনি সম্প্রতি সাভারের গণবিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞান ও সমাজকর্ম বিষয়ে অনার্স শেষ করেছেন। অনার্সে তাঁর সিজিপিএ-৩.৭৭। অনার্সের ফলাফলের দিক দিয়ে লাকী যৌথভাবে তাঁর বিভাগে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছেন।

লাকী তাঁর বাবা ও মায়ের দিকের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি, যিনি এসএসসি, এইচএসসি ও অনার্স পাস করেছেন। মাস্টার্স শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন তাঁর।

মাত্র ১৭ বছর বয়সে লাকীর বিয়ে হয়। এখন তাঁর বয়স ২৯। এক মেয়ে ও এক ছেলের মা তিনি। স্বামী-সন্তান নিয়ে থাকেন সাভারে। গত রোববার প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে লাকী শোনালেন তাঁর বন্ধুর পথ অতিক্রমের গল্প।

লাকী জানালেন, তাঁর বাবা পেশায় বাসচালক। তাঁরা তিন বোন। সংসারের খরচ সামলে মেয়েদের পড়ানো তাঁর বাবা জন্য বেশ কষ্টকর ছিল। তবে পড়ালেখার ব্যাপারে লাকীর ছোটবেলা থেকেই ভীষণ আগ্রহ। পঞ্চমের পর অষ্টম শ্রেণিতেও পান বৃত্তি। পরিবারের আর্থিক সংকটের কারণে অষ্টম শ্রেণি থেকেই তাঁর ওপর বিয়ের চাপ বাড়তে থাকে। তবে এই পর্যায়ে বিয়েতে তাঁর ছিল ঘোরতর অমত।

লাকী ২০০৬ সালে নোয়াখালীর রায়পুর পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। এসএসসির পর ভর্তি হন কলেজে। কলেজ ছিল বাড়ি থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে। পারিবারিক একটি ঘটনার জেরে একপর্যায়ে লাকীর কলেজ যাওয়া বন্ধ করে দেন বাবা।

লাকী আক্তার
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

পড়া বন্ধ হয়ে গেলে প্রচণ্ড মানসিক কষ্টে ভুগতে থাকেন লাকী। তা ছাড়া বিয়ের জন্য তাঁর ওপর চাপ বাড়তে থাকে। একবার বাড়ি থেকে পালাতেও চেয়েছিলেন তিনি। কারণ, তাঁর মনে হয়েছিল, বিয়ে হলে তাঁর পড়ালেখা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে।

লাকী টুকটাক লেখালেখি করতেন। প্রথম আলোর বন্ধুসভায় একটি লেখা আহ্বান করা হয়েছিল। লেখা জমা দেওয়ার জন্য যোগাযোগ নম্বরে ফোন করেন তিনি। সেই সুবাদে পরিচয় হয় বন্ধুসভার আবু সুফিয়ানের সঙ্গে। আবু সুফিয়ান তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

লাকী বলেন, ‘আবু সুফিয়ান আমার বিপদে পাশে এসে দাঁড়ান। তাঁর আর আমার পরিবারের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান ছিল। তা সত্ত্বেও তিনি আমাকে বিয়ে করতে চান। তাঁকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাই।’

২০০৮ সালে বিয়ের পর লাকীর শুরু হয় নতুন সংগ্রাম। তাঁর স্বামী তখনো শিক্ষার্থী। টিউশনি ও বাবার কাছ থেকে কিছু আর্থিক সহায়তা নিয়ে সংসার চালান তিনি। লাকীর কিছু শারীরিক জটিলতা থাকায় চিকিৎসকের পরামর্শে দ্রুত সন্তান নিতে হয়। ২০০৯ ও ২০১১ সালে দুই সন্তানের জন্ম হয়। এই সময় শারীরিক অসুস্থতায় তাঁকে দীর্ঘ সময় হাসপাতালেও থাকতে হয়।

সব সামলে নিয়ে লাকী ২০১৪ সালে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে এইচএসসিতে ভর্তি হন। ২০১৬ সালে এইচএসসি পাস করেন তিনি। এইচএসসির পর শুরু হয় আরেক যুদ্ধ। পড়াশোনায় বিরতি ও বয়সের ফেরে সরকারি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক খরচ।

লাকী জানান, তাঁর স্বামী তখন পূবালী ব্যাংকে জুনিয়র অফিসার (ক্যাশ) হিসেবে চাকরি পেয়েছেন মাত্র। বেতন খুব বেশি নয়। পরিবারের সদস্যসংখ্যা চার। ছোট ছেলে কিছু জটিলতা নিয়ে জন্ম নেওয়ায় তার চিকিৎসার পেছনে খরচ করতে হয়। সে সময় ফেসবুকে বাদল সৈয়দ নামের এক ব্যক্তির একটি লেখা পড়েন তিনি। ফেসবুকভিত্তিক সংগঠন পে ইট ফরোয়ার্ডের প্রতিষ্ঠাতা বাদল সৈয়দ। কোনো কিছু না ভেবে তাঁকে ফোন করেন লাকী। তাঁকে জানান যে তিনি পড়ালেখা করতে চান। লাকীর পড়ালেখার দায়িত্ব নেওয়ার কথা জানান বাদল সৈয়দ।

লাকী আক্তার
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

লাকী বলেন, গণবিশ্ববিদ্যালয়ে তিনবার যোগাযোগ করে অবশেষে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান তিনি। ভালো ফল করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরে বৃত্তিও পান।

চট্টগ্রামের কর কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা বাদল সৈয়দ টেলিফোনে বললেন, পে ইট ফরোয়ার্ড মেধাবী শিক্ষার্থী ও দেশ-বিদেশে থাকা দাতাদের মধ্যে সংযোগ করিয়ে দেয়। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করছেন কি না, তা নজরদারি করা হয়। লাকী এই সুযোগের সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছেন।

পে ইট ফরোয়ার্ডের নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ ওয়াহিদ হোসেন বলেন, ‘আমার নিজের ছেলে পরীক্ষায় ভালো করলে যেমন আনন্দ লাগে, লাকী বা লাকীর মতো আমাদের অন্য শিক্ষার্থীরা যখন ভালো ফল করেন, তখন একই আনন্দ লাগে। ওরা তো আমাদেরই সন্তান।’

গণবিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক শহীদ মল্লিক টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘লাকীকে পদে পদে সংগ্রাম করে সামনের দিকে এগোতে দেখেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু থেকেই সে ভালো ফল করে আসছিল। আমি সব সময়ই ক্লাসে অন্য শিক্ষার্থীদের কাছে লাকীর উদাহরণ দিই।’

লাকী মাস্টার্স শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। তিনি জানান, যেসব মেয়ে পড়াশোনা করতে চান, কিন্তু আর্থিক সংগতি নেই, তিনি প্রতিষ্ঠিত হয়ে ভবিষ্যতে তাঁদের পাশে দাঁড়াতে চান।