‘পদ্মাপাড়ের সক্রেটিস’

অনেকের বসতবাড়ি কেড়ে নিয়েছে পদ্মা। নিঃস্ব হয়েছেন অনেকেই। ভাঙনে পাউবোর বাঁধ ধসে গেছে। ভাঙনে উপজেলা মূল সদরই যখন আক্রান্ত, ঠিক তখনই এগিয়ে এলেন হরিপদ সূত্রধর। তবে এখন নাটক নয়, ভাঙন ঠেকাতে সম্পৃক্ত করলেন পদ্মাপাড়ের তরুণদের।

পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানের আগে শিশুদের সঙ্গে শিক্ষক হরিপদ সূত্রধরছবি: সংগৃহীত

শেষ সহায়–সম্বল হারিয়ে নদীভাঙুনি মানুষের মধ্যে হাহাকার। কষ্টের ঢেউ আছড়ে পড়ে দুর্গত মানুষের হৃদয়জুড়ে। পাঁজরভাঙা মানুষগুলো যখন দৈন্যদশায়, সমাজপতিদের চোখ তখন ত্রাণের পানে। ভাঙন বাড়বে, সাহায্য-সহায়তা আসবে। লুটপাটের সুযোগটাও বাড়বে সমাজপতিদের। এই সুযোগ কি হাতছাড়া যায়! কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ।

অসহায় মানুষগুলো সমবেত হলেন। এরই মধ্যে অসহায় মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা। পাহাড়ের চূড়া থেকে পাথর এক হাত থেকে আরেক হাতে। পাথরগুলো ফেলা হয় নদীর তীরে। ভাঙন রুখতে সমবেত মানুষের সে কী প্রচেষ্টা! ভাঙন ফিরল, রক্ষা পেলে তীরের বসতভিটা। ক্ষত কাটিয়ে নতুন আলোয় গা ভাসালেন স্বপ্নচারী মানুষগুলো।

বহে পদ্মা নীল রং নাটকের দৃশ্য এটি। মঞ্চায়িত হয়েছিল জাতীয় শিশু-কিশোর নাট্যোৎসবে রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমিতে ১৯৯৭ সালে। দর্শকসারিতে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার পদ্মাপাড়ের তরুণেরাও ছিলেন। এ থেকেই হৃদয়ে দাগ কাটে পদ্মাপাড়ের তরুণদের। নাটকটি রচনা করেন হরিরামপুরের বাসিন্দা শিক্ষক হরিপদ সূত্রধর (৭০)। নির্দেশনায়ও ছিলেন তিনি।

অনেকের বসতবাড়ি কেড়ে নিয়েছে পদ্মা। নিঃস্ব হয়েছেন অনেকেই। ভাঙনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বাঁধ ধসে গেছে। ভাঙনে উপজেলা মূল সদরই যখন আক্রান্ত, ঠিক তখনই এগিয়ে এলেন হরিপদ সূত্রধর। তবে এখন নাটক নয়, ভাঙন ঠেকাতে সম্পৃক্ত করলেন পদ্মাপাড়ের তরুণদের।

২০১৫ সালের মাঝমাঝি সময়ে এক বিকেলে স্কুলের মাঠে সভা ডাকলেন শিক্ষক হরিপদ। পদ্মাপাড়ের শত শত তরুণ উপস্থিত হলেন সভায়। স্বেচ্ছাশ্রমে ভাঙনরোধে কী করা যায়! তখন তাঁর মাথায় এল ধসে পড়া বাঁধের পাশে থাকা তিন শতাধিক সিসিব্লকের কথা। সেগুলোর উত্তম ব্যবহার করলে হয়তো ভাঙন কিছুটা রোধ করা যাবে। পরদিন তরুণদের নিয়ে লেগে পড়লেন সিসিব্লকগুলো পদ্মার তীরে ফেলতে। যে স্থানে (সদরের আন্ধারমানিক) ফেলা হলো সিসিব্লক, সেটা ভাঙন থেকে রক্ষা পেল।

স্কুলশিক্ষক হরিপদ সূত্রধর শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসর নিয়েছেন দেড় যুগের বেশি সময় আগে। তবে এই বৃদ্ধ বয়সেও তিনি একটুও স্থির নন, চিন্তা ও কর্মে এখনো তরুণ। প্রতিনিয়ত নিজের জ্ঞান, প্রজ্ঞা, প্রগতিচিন্তায় শত তরুণের হৃদয় প্রজ্জ্বালন করছেন। এ ছাড়া খেলাধুলা, পরিবেশ রক্ষাসহ বিভিন্ন সামাজিক কর্মযজ্ঞে শুধু নিজেকেই সম্পৃক্ত রাখেননি, তরুণদেরও সম্পৃক্ত করেছেন।

১৯৪৬ সালে হরিরামপুরের হরিণা গ্রামে (পদ্মাগর্ভে বিলীন) কাঠমিস্ত্রি পরিবারে হরিপদর জন্ম। পদ্মার ভাঙনে নিজেও হারিয়েছেন বসতভিটা। এখন সদরের খালপাড় বয়ড়া গ্রামে স্থায়ী হয়েছেন। শিক্ষক, নাট্যকার, অভিনেতা, প্রগতিশীল রাজনীতিক, সমাজকর্মী হিসেবে এখনো তরুণ ও যুবকদের মধ্যে দ্যুতি ছড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি।

পদ্মার ভাঙনে বিপর্যস্ত জনপদ হরিরামপুর। এই জনপদে একসময় অভাব, দারিদ্র্য, দুঃখ, হাহাকার ছিল নিত্যসঙ্গী। এ অঞ্চলে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির চর্চাকে বিলাসিতা মনে হলেও সেখানকার মানুষ দারুণ সংস্কৃতিপ্রেমী। লোকায়ত সংস্কৃতির চর্চা তো ছিলই, কতিপয় মানুষের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল নাগরিক সংস্কৃতির চর্চাও। সেই চর্চার প্রাণপুরুষ হরিপদ। এ কারণে উপজেলাবাসী তাঁকে ভালোবেসে ‘পদ্মাপাড়ের সক্রেটিস’ বলে ডাকে।

১৯৬৭ সালে ঢাকার টিটি কলেজ থেকে বিএড সম্পন্ন করেন তিনি। উপজেলার রামকৃষ্ণপুর জুনিয়র হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু। পরে কিছুদিন তিনি পাবনার ধোবাখোলা হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। ১৯৭০ সাল থেকে ২০০৩ সালে অবসর গ্রহণের আগপর্যন্ত তিনি পাটগ্রাম অনাথবন্ধু সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন।

তাঁরই কৃতী ছাত্র বর্তমানে আইন মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তৈয়বুল আজহারের ভাষায়, যেটুকু শেখাতেন তিনি, সেটুকু পরিপূর্ণভাবেই শেখাতেন। শ্রেণিকক্ষের বই পড়ানোর বাইরেও সমাজ, রাষ্ট্র, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি নানান বিষয়ে তাঁর দার্শনিক দ্যুতিসমৃদ্ধ মন্তব্যগুলো শিক্ষার্থীদের সামনে মণিমুক্তার মতো ঝরে পড়ত। তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে শিক্ষার্থীদের যুক্ত করতেন। বড় কিছু ভাবতে শেখাতেন, বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখাতেন।

হরিপদ ধর সবচেয়ে বেশি নিবেদিত থেকেছেন নাট্যচর্চায়। নিজেই নাটক লিখেছেন, নির্দেশনা দিয়েছেন, অভিনয়ও করেছেন। হরিরামপুরে নাটক মঞ্চায়নের স্থায়ী মঞ্চ না থাকায় স্কুলের হলঘর বা খোলা মাঠে মঞ্চ বানিয়ে নাটকগুলো মঞ্চস্থ হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, মঞ্চসজ্জা, আলোক নিয়ন্ত্রণ, পোশাক পরিকল্পনা, সংগীত পরিচালনা সবই সামাল দিতে হয়েছে তাঁকে।

১৯৬৭ সালে রামকৃষ্ণপুর জুনিয়র হাইস্কুলে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মামলার ফল’ গল্পকে নাট্যরূপ দিয়ে মঞ্চস্থ করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাঁর নাট্যজীবন। ১৯৬৯ সালে পাবনার বেড়ার ঘোষশিলন্দায় মঞ্চস্থ হয় ‘রামের সুমতি’ গল্পের নাট্যরূপ। এরপর একে একে তিনি লিখেছেন ২৬টি মৌলিক নাটক এবং বিভিন্ন কবিতা, গল্প, উপন্যাস অবলম্বনে লিখেছেন আরও ১৪টি নাটক। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চে জাতীয় শিশু-কিশোর নাট্যোৎসব এবং জাতীয় নাট্যোৎসবে তাঁর একাধিক নাটক মঞ্চায়িতও হয়েছে।

হরিপদর মৌলিক নাটকের মধ্যে রয়েছে অমর একুশে (১৯৭৯), জন্মতিথির নাম (১৯৮১), পোস্টার (১৯৮২), সারেন্ডার (১৯৮৩), বর্ণ পরিচয় (১৯৮৫), ওরা কোথায় (১৯৮৬), বাণিজ্য (১৯৮৭), গর্দভপুরের আকাল (১৯৮৮), নামে ঢল ওই জনতার (১৯৯০), দুলিরা বড় বেশি কথা কয় (১৯৯৪), আর কত দূর (১৯৯৬), বহে পদ্মা নীল রং (১৯৯৭), মুক্তি (১৯৯৭), পিকনিক (১৯৯৯), ছিনতাই (২০০০), বাহান্নর খোকারা (২০০৪), যদি না জাগে ঢেউ (২০০৮), কোনো এক শিল্পীর খোঁজে (২০০৯), তামশা (২০১০), কেনারাম বেচারাম, বিদ্রোহী দুখু (২০১০), তোমার জন্য ভালোবাসা, শুভেচ্ছা (১৯৯৭), ভূত তাড়ানোর গান, ঝড় (১৯৯৬) ইত্যাদি। এ ছাড়া তিনি কয়েকটি গল্প ও উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে মামলার ফল (১৯৬৭), রামের সুমতি (১৯৬৯), বিন্দুর ছেলে (১৯৭০), কিষাণ বৌ (১৯৭৪), জুতা আবিষ্কার (১৯৮৬), রানার (১৯৮৮), দুই বিঘে জমি (১৯৯০), অন্ধ বধু (১৯৯২), চিঠি (২০০০), সামান্য ক্ষতি (২০০২), কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ (২০০২), কংস বধ (২০০৩), ঠাকুর নরোত্তম (২০০৪), মেঘনাদ বধ (১৯৭৯) ইত্যাদি। বিটিভিতে তাঁর কয়েকটি মঞ্চনাটক প্রচারিত হয়েছে।

১৯৫৪ সালে হলদে ঘাটের যুদ্ধ নাটকে অভিনয় দিয়ে তাঁর অভিনয় শুরু। ১৯৯৭ সালে জাতীয় নাট্যোৎসবে তিনি নিজের লেখা মুক্তি নাটকে অভিনয় করেন। নৌকাডুবি টিভি নাটকসহ হরিশচন্দ্র ও গণদেবতা নামে দুটো যাত্রাপালায়ও তিনি অভিনয় করেন। তিনি সরকারের বয়স্ক ভাতাসংক্রান্ত একটি বিজ্ঞাপনচিত্রেও অভিনয় করেন।

হরিপদ সাংস্কৃতিক সংগঠকও। ১৯৮৮ সালে হরিপদর হাত ধরে হরিরামপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় সাহিত্য-সাংস্কৃতিক পরিষদ। এ সংগঠনের নেতৃত্বে প্রতিবছর বাংলা নববর্ষের প্রথম প্রহরে হরিরামপুরে ভিন্নধর্মী বর্ষবরণ শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু হয়, যা জলসত্র বন্ধুছায়া ও হরিরামপুর বন্ধুমঞ্চ সংগঠনের মাধ্যমে আজও চলমান।

উপজেলার সরকারি গ্রন্থাগারটি ছিল জ্ঞানচর্চার অন্যতম কেন্দ্র। তবে ২০০২ সালে এই গ্রন্থাগার বন্ধ হয়ে যায়। বিষয়টি তাঁকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। ২০১৭ সালে তরুণ ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে সভা করেন তিনি। সভায় তৎকালীন ইউএনও আরেফিন রেজোয়ানও উপস্থিত ছিলেন। অবশেষে সবার প্রচেষ্টায় প্রাণ ফিরে পায় গ্রন্থাগারটি। লাইব্ররিতে এখন ১০ হাজারের বেশি বই রয়েছে। শিশু, কিশোর ও তরুণদের বই পড়ার জন্য গ্রন্থাগারগামী করছেন তিনি। বর্তমানে তিনি গ্রন্থাগারটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।

এবার বন্যার পরপরই উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করেন স্থানীয় তরুণেরা। এর সঙ্গেও জড়িত হরিপদ। দেশের প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি রেখেছেন অগ্রণী ভূমিকা। তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির হরিরামপুর উপজেলা কমিটির সভাপতিও।

হরিপদর জীবদ্দশায় তাঁকে নিয়ে স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত এ স্মারকগ্রন্থ সম্পাদনা করেন তাঁরই ছাত্র তৈয়বুল আজহার। গ্রন্থটির প্রচ্ছদ করেছেন চিত্রশিল্পী আজহার ফরহাদ। তাঁর ছাত্র কথাসাহিত্যিক আহমাদ মোস্তফা কামাল ও মনজুর শামস তাঁদের লেখা একাধিক বই তাঁর নামে উৎসর্গ করেন। হরিপদ এই কর্মযজ্ঞের স্বীকৃতি পেয়েছেন। ২০১৯ সালের ১৯ নভেম্বর জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে আলোচিত নাট্যদল ‘বটতলা’ আয়োজিত আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসবে ‘নিভৃতচারী নাট্য সংগঠক ও সংস্কৃতি সাধক’ শাখায় হরিপদকে সম্মাননা দেওয়া হয়।

আজহারুল ইসলাম সম্পাদিত মানিকগঞ্জের শত মানিক বইয়ে তাঁর জীবনী অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া ২০১১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জলসত্র বন্ধুছায়া’ নামের একটি সংগঠনের আয়োজনে দুই দিনব্যাপী ‘হরিপদ সূত্রধর স্মারক গ্রন্থ প্রকাশনা ও নাট্যোৎসব’ উদ্‌যাপিত হয়েছে। প্রথম আলোর ২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতেও তাঁকে সম্মাননা দেওয়া হয়।

এই মানুষটি এলাকার তরুণদের নিয়ে সমাজ বিনির্মাণে এখনো কাজ করছেন। তিনি বলে থাকেন, ‘এই সমাজ আমাকে অনেক দিয়েছে। তাই তো তাকে ধারণ করি, লালন করি। তরুণদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কলুষিত সমাজের সব অন্ধকার দূর হবে, ভোরের আলো প্রস্ফুটিত হবে।’