‘পরম্পরা’য় শুধুই শূন্যতা

কারাবন্দী অবস্থায় ২৫ ফেব্রুয়ারি মারা যান লেখক মুশতাক। আর গত সোমবার চলে গেলেন তাঁর বাবা।

বাবা আবদুর রাজ্জাক ও মা জেবুন্নেসার সঙ্গে সস্ত্রীক মুশতাক আহমেদ
পারিবারিক অ্যালবাম থেকে

সারা জীবন শিক্ষকতা করেই কাটিয়েছেন জেবুন্নেসা রাজ্জাক। এই ৮১ বছর বয়সে স্বজনদের উৎসাহে অনলাইনে খাবারের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। অর্ডারও আসছিল বেশ। যা কিছুই রাঁধতেন অল্প করে ছোট্ট একটা বক্সে তুলে রাখতেন রেফ্রিজারেটরে। মনে আশা, ছেলে মুশতাক আহমেদ একদিন কারাগার থেকে বের হবেন। সামনে বসিয়ে যত্ন করে খাওয়াবেন তাঁকে। রেফ্রিজারেটরটা একসময় ভরে গেল। আর ছেলে ফিরল লাশ হয়ে।

স্বামী, ছেলে আর ছেলের বউকে নিয়ে লালমাটিয়ার ‘পরম্পরায়’ ছিল জেবুন্নেসার সংসার। এখন সেখানে শুধুই শূন্যতা। গত সোমবার বিকেলে ছেলের মৃত্যুর ৩৯ দিনের মাথায় স্বামী আবদুর রাজ্জাকও মারা যান। এখনো পুরোপুরি সুস্থ নন পুত্রবধূ লিপা আক্তার। জেবুন্নেসা রাজ্জাক ও আবদুর রাজ্জাক দম্পতির মেয়ে ইশরাত আরা আর ফারহাত আরা যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বহু দিন। গত বছরের মে মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় মুশতাক আহমেদ গ্রেপ্তার হন। ছয়বার জামিন আবেদন নাকচ হওয়ার পর কারাবন্দী অবস্থাতেই গত ২৫ ফেব্রুয়ারি মারা যান তিনি।

মুশতাক আহমেদের অনুপস্থিতিতে এই পরিবার কেমন আছে, জানতে গতকাল মঙ্গলবার কথা হয় নাফিসুর রহমানের সঙ্গে। নাফিসুর একই সঙ্গে মুশতাকের খালাতো ও চাচাতো ভাই। লালমাটিয়ার পরম্পরায় একটি ফ্ল্যাটে থাকেন তিনি।

নাফিসুর প্রথম আলোকে বলেন, মুশতাক আহমেদের মা–বাবা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন ছেলের। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি মুশতাকের আবারও জামিন আবেদন নাকচ হয়েছে শুনে জেবুন্নেসা রাজ্জাক আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমার জীবদ্দশায় বোধ হয় ছেলেটাকে আর দেখা হলো না।’ লিপা আক্তার অসুস্থ হয়ে তখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। গ্রেপ্তারের পর দুজনের একবারও দেখা হয়নি। লিপা এই পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছিলেন না। মুশতাক আহমেদ ও লিপা আক্তারকে স্বজনেরা বলতেন, ‘ম্যাচ মেড ইন হেভেন’।

২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে লিপা আক্তারের ফোনটাই প্রথম বেজেছিল। ফোন বাসায়, লিপা হাসপাতালে। আবদুর রাজ্জাক অচেনা নম্বর দেখে ফোন ধরেননি তখন। খানিক পর তিনি ও জেবুন্নেসা জব্বার দুজনেই ঘুমিয়ে পড়েন। এবার নাফিসুর রহমানের ফোন বাজে। অপর প্রান্তে লিপা আক্তারের ভাই। তিনি জানান, ডেপুটি জেলার ফোন করে জানিয়েছেন, মুশতাক আহমেদ মারা গেছেন। ভাইয়ের অধিক ছিল যে ভাই, তাঁর জন্য নিজের কষ্টের চেয়ে বড় হয়ে দেখা দেয় বৃদ্ধ মা–বাবাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে কী করে এই খবর দেবেন, সেই চিন্তা। একটা সময় আত্মীয়স্বজনকে ডেকে মুশতাক আহমেদের মা–বাবাকে জানান, তাঁদের ছেলে মারা গেছেন।

ছোটবেলা থেকে ভীষণ ডানপিটে ছিলেন মুশতাক আহমেদ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুর রাজ্জাক কুষ্টিয়ার দর্শনায় কেরু অ্যান্ড কোং–এর মহাব্যবস্থাপক ছিলেন। মুশতাক ও তাঁর দুই বোনের জন্ম সেখানেই। এরপর ইস্টার্ন কেবলসে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের চাকরি নিয়ে আবদুর রাজ্জাক সপরিবারে চট্টগ্রামে চলে যান। ডানপিটে ছেলেটাকে ঠিকঠাক করতে সে সময় পাঠানো হয় ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে। সেখানেও প্রথাভাঙার দলে ছিলেন মুশতাক। কোনো কাজেই লম্বা সময় মন বসত না তাঁর। টি গার্ডেনে চাকরি থেকে পর্যটনবিষয়ক প্রতিষ্ঠানে, সেখান থেকে যুক্তরাজ্যে পড়তে যাওয়া, এরপর আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থায় (আইওএম) কাজ করেছেন। থিতু হতে পেরেছিলেন শুধু কুমিরের চাষে। তা–ও একসময় ছাড়তে হয়। দুশ্চিন্তা থাকলেও ছেলেকে নিয়ে দুঃখ ছিল না। প্রায়ই বলতেন, ‘মুশতাক কি অন্যায় বা অসত্য কিছু লিখেছিল? লেখেনি। জেলে থেকে কষ্ট করেছে শুধু। ও নিয়ে আক্ষেপ নেই, অহংকার আছে।’