পরিকল্পিত বিপর্যয়

এ এ কে নিয়াজি

আমাকে যে দুর্ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে, তাতে আমার কোনো হাত অথবা ইচ্ছা ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তান রক্ষায় প্রেসিডেন্ট আমাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিলে আমি বিচলিত হয়ে পড়ি। তখন আমার সামনে দুটি পথ খোলা ছিল। এক. পশ্চিম পাকিস্তানকে হারানোর ঝুঁকি নেওয়া; অথবা দুই. আমার সুনাম, আমার ক্যারিয়ার, আমার ভবিষ্যৎ ও পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর মহান ঐতিহ্যকে বিসর্জন দেওয়া। পশ্চিম পাকিস্তান রক্ষায় প্রেসিডেন্টের নির্দেশে আমি শেষোক্ত পথই বেছে নিই।...

যুদ্ধ জয়ের আনন্দে বাঙালিরা তখন আত্মহারা ছিল। কয়েক ঘণ্টা আগেও তারা আমাদের রক্তের জন্য পিপাসার্ত ছিল। কিন্তু মুহূর্তে তারা বদলে যায়। তাদের দেখে মনে হয়েছে, আমাদের প্রতি তাদের যেমন ঘৃণা রয়েছে, তেমনি রয়েছে মমত্ববোধও। আমি তাদের বললাম, ‘বহু রক্ত ঝরেছে। এখন আর অনুতপ্ত হয়ে লাভ নেই। আমরা আমাদের নেতাদের দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছি। নেতারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রক্তপাতের পথ বেছে নিয়েছেন। রোমান সম্রাটরা যেভাবে মল্লযোদ্ধাদের লড়াই দেখতেন, আমাদের নেতারা ঠিক সেভাবে যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে দাঁড়িয়ে এ রক্তপাত দেখে তৃপ্ত হয়েছেন। যুদ্ধে ফলাফল যা–ই হোক, বিজয়ী হবেন তারাই।’ আমি বাঙালিদের সাফল্য কামনা করি এবং আশা প্রকাশ করি যে আমাদের কালে না হলেও আমাদের নাতি-পুতিদের কালে হলেও এ ক্ষত নিরাময় হবে এবং বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে দুটি দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে।

ভুট্টো নিঃশর্তভাবে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেন। মুজিব ছিলেন পাকিস্তানের হাতে একটি তুরুপের তাস। শেখ মুজিব, পাকিস্তানের শিবিরে আটক হাজার হাজার বাঙালি সৈন্য, ভারতীয় যুদ্ধবন্দী এবং ভারতের স্পর্শকাতর ভূখণ্ড ফিরোজপুর হেডওয়ার্কস পাকিস্তানের হাতে থাকায় ভারতের সঙ্গে যুদ্ধবন্দী বিনিময়ে পাকিস্তান ছিল একটি শক্তিশালী অবস্থানে। কিন্তু ভুট্টো কলমের এক খোঁচায় পাকিস্তানের এ শক্তিশালী অবস্থানকে তছনছ করে দেন। শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়ার পর পাকিস্তান দর–কষাকষিতে দুর্বল অবস্থানে এসে দাঁড়ায়।

ভুট্টো ছিলেন খুবই চতুর। কোন ঘটনা তাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রত্যাবাসনে ব্যাঘাত ঘটায়? শেখ মুজিবকে ব্যবহার করে ভারত ও বাঙালিদের কাছ থেকে সর্বাধিক সুবিধা আদায়ের সুযোগ তাঁর ছিল। তা ছাড়া তিনি আমাদের হাতে থাকলে আন্তর্জাতিক চাপে দ্রুত সংকট নিষ্পত্তিও হতে পারত। ভুট্টো কেন তাড়াহুড়ো করে মুজিবকে ছেড়ে দিতে গেলেন? ইরানের শাহ্র পাকিস্তানে আসার কথা ছিল। তিনি শেখ মুজিবকে ভবিষ্যতে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি সম্পর্ক রাখার ব্যাপারে রাজি করানোর চেষ্টা করতেন। কিন্তু তাঁকে সে সুযোগ দেওয়া হয়নি। শাহ্র পাকিস্তান এসে পৌঁছানোর আগেই মুজিবকে লন্ডনগামী বিমানে তুলে দেওয়া হয়।

পরাজিত লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজিকে আত্মসমর্পণ মঞ্চের দিকে িনয়ে যাচ্ছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর এ টি এম হায়দার, ১৬ িডসেম্বর ১৯৭১
ছবি: সংগৃহীত

ভুট্টো ইস্টার্ন কমান্ডের সৈন্য সংখ্যা ৪৫ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৯৬ হাজার পর্যন্ত উল্লেখ করতেন এবং সিমলা চুক্তিতে এ সংখ্যা ১ লাখ বলে উল্লেখ করা হয়। ইতিহাসে একটি দেশের প্রেসিডেন্ট তাঁর নিজ দেশের ভাগ্যবিড়ম্বিত সৈন্যদের সম্পর্কে এমন মিথ্যাচার করেছেন কি না সন্দেহ। ভুট্টোর এ মিথ্যাচার গুল হাসান অথবা টিক্কা—কেউই সংশোধন করেননি। ইস্টার্ন কমান্ডে পাকিস্তানের নিয়মিত বাহিনীর সৈন্য ছিল মাত্র ৩৪ হাজার। রেঞ্জার্স, স্কাউট, মিলিশিয়া ও বেসামরিক পুলিশ মিলিয়ে আরও ছিল ১১ হাজার। সব মিলিয়ে ইস্টার্ন কমান্ডে সশস্ত্র সদস্য ছিল ৪৫ হাজার। নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্য, ইন্টার্ন কমান্ডের সদর দপ্তর, সামরিক আইন প্রশাসকের কার্যালয়, ডিপো, প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, ওয়ার্কশপ ও ফ্যাক্টরি প্রহরায় নিয়োজিত ব্যক্তি, নার্স, মহিলা ডাক্তার, পাচক, ধোপা, নাপিতসহ হিসাব করলে এ সংখ্যা বড়জোর ৫৫ হাজারে পৌঁছায়। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই ৯৬ হাজার অথবা ১ লাখ হয় না। ৪৫ হাজারের বাইরে যাঁদেরকে হিসাবে ধরা হয়, তাঁরা হচ্ছেন বেসামরিক কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং মহিলা ও শিশু। ভারতীয়রা যেখানে ইস্টার্ন কমান্ডে নিয়োজিত, তাদের সৈন্য সংখ্যা ১২ ডিভিশনের স্থলে ৮ ডিভিশন বলে উল্লেখ করছে, সেখানে ভুট্টো আমাদের সৈন্য সংখ্যাকে ৪৫ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৯৬ হাজার বলে উল্লেখ করতেন। ইস্টার্ন কমান্ড এবং এ কমান্ডের সৈন্যদের বিদ্রূপ করা যদি উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে সে উদ্দেশ্য অর্জিত হয়নি। এটা গোটা জাতিকে বিদ্রূপ করার শামিল এবং ভারতীয় অপপ্রচারকে জোরদার করার একটি প্রচেষ্টামাত্র। ভারতীয়রা দাবি করছে যে তারা ৯৬ হাজার সৈন্যের একটি বিরাট বাহিনীকে পরাজিত করেছে। ভুট্টো ইস্টার্ন কমান্ডের সৈন্য সংখ্যা বাড়িয়ে বলে ভারতের দাবিকেই প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন।

এটা মনে রাখতে হবে যে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট ও সরকারপ্রধান হিসেবে জেনারেল ইয়াহিয়া সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন, সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ নয়। অন্যদিকে, পূর্ব পাকিস্তানে আমার হাইকমান্ড ও প্রাদেশিক সরকার আমাকে পরিত্যাগ করে। এ জন্য বেসামরিক ও সামরিক—উভয় বিষয়ে আমাকে একাই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।...

সেনাবাহিনীর যুদ্ধবন্দী ও বেসামরিক লোকজনকে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ক্যাম্পে নেওয়া হয়। লে. জেনারেল সগৎ সিং আমাকে জানান যে ২০ ডিসেম্বর সিনিয়র অফিসারদের কলকাতায় নেওয়া হবে। তবে ভারতীয়রা রাও ফরমান আলীকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রেখে যেতে চেয়েছিল। ৫ জুন গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা থাকায় প্রতিটি কাজকর্মে তাঁর হাত ছিল এবং তিনি নির্বাচন পরিচালনা ও জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতে চূড়ান্ত ভূমিকা পালন করেছেন। বস্তুতপক্ষে, ফরমান ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধা সৃষ্টিতে সহায়তা করেছিলেন। তাঁর ভূমিকায় বাঙালিরা ক্রুদ্ধ হয়। ২৫ মার্চের সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা ও পরিচালনায় তাঁর বিরাট ভূমিকা ছিল। বাঙালিরা তাঁকে ক্ষমা করতে প্রস্তুত ছিল না। আমি তখন জোর দিয়ে বললাম যে জেনারেল মানেকশর প্রদত্ত আশ্বাস অনুযায়ী কোনো পাকিস্তানি সৈন্যকে তদন্তের জন্য ভারতীয়দের কাছে হস্তান্তর করা যাবে না। কথিত আচরণসংক্রান্ত যেকোনো তদন্ত রিপোর্ট সিদ্ধান্তের জন্য একটি পাকিস্তানি আদালতে পেশ করতে হবে। একইভাবে গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থায় কর্মরত কোনো কর্মকর্তাকেও আটক করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। আমাদের সঙ্গে আলবদর ও আলশামসের কয়েকজন সদস্যও ছিল। তারা যুদ্ধে আমাদের সহায়তা করেছে। এ জন্য বাঙালিরা তাদের খুঁজছিল।

অনুবাদ: ডা. মিজানুর রহমান কল্লোল

সূত্র: দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান, আফসার ব্রাদার্স, ২০০৮

লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি: মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান