পরিচয়ের অপেক্ষায় জুরাইন কবরস্থানের ফলকগুলো

সারি সারি কবরের ফলকে ডিএনএ নমুনা নম্বর। এ রকম ডিএনএ নম্বরের পরিচয়েই জুরাইন কবরস্থানে শায়িত ২৯১ জন। গত বৃহস্পতিবার ছবিটি তুলেছেন হাসান রাজা
সারি সারি কবরের ফলকে ডিএনএ নমুনা নম্বর। এ রকম ডিএনএ নম্বরের পরিচয়েই জুরাইন কবরস্থানে শায়িত ২৯১ জন। গত বৃহস্পতিবার ছবিটি তুলেছেন হাসান রাজা

রাজধানীর জুরাইন কবরস্থানে অধিকাংশ কবরের ওপর মৃত ব্যক্তির নাম লেখা। কিছু কবর দেখেই বোঝা যায়, নিকটাত্মীয় অথবা তাঁদের হয়ে অন্য কেউ এগুলোর যত্ন নেন। কিছু কবরে নাম লেখা নেই। কবরস্থানের পেশ ইমাম হাফেজ মাওলানা মো. সোয়েব হোসেন জানালেন, এসব কবরে বেওয়ারিশ লাশ।
কবরস্থানের চার ও পাঁচ নম্বর ছাউনির মধ্যে আর এক ধরনের কবর চোখে পড়ে। অযত্নে থাকা কবরগুলো একটি আরেকটির খুব কাছাকাছি। মাটির চেয়ে সামান্য উঁচু। আশপাশে পানি জমে আছে। প্রতিটি কবরের মাথার দিকে কাঠি গাড়া। কাঠির মাথায় কালো ফলক, তাতে সাদা অক্ষরে শনাক্তকরণ নম্বর। গুনে দেখা যায় ২৯১টি কবর। তবে এগুলো বেওয়ারিশ লাশের কবর না। রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় নিহত অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের কবর।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরির প্রধান শরীফ আক্তারুজ্জামন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আশা করা যাচ্ছে আগামী সেপ্টেম্বরের শেষ বা অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে এদের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হবে।’ এই ল্যাবরেটরিতে ডিএনএ পরীক্ষা চলছে।
কবরের একটি ফলকে লেখা: ‘ডিএনএ নং ১৩৪, ডিএমসিএইচ, তাং ১১-৫-২০১৩, লেন নং ৯, কবর নং বি/৫২’। এ রকম প্রতিটি কবরের জন্য পৃথক ডিএনএ নম্বর। এসব অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে কবর দেওয়ার আগে দাঁত বা হাড়ের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল ডিএনএ বিশ্লেষণের জন্য। সংগৃহীত প্রতিটি নমুনার পৃথক নম্বর আছে, সেই নম্বরের সঙ্গে কবরে রাখা শনাক্তকরণ নম্বরের মিল আছে।
অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির পাশাপাশি এসব কবরে থাকা মৃত ব্যক্তিদের মা, বাবা, ছেলে, মেয়ে বা নিকটাত্মীয় দাবি করেছেন যাঁরা, তাঁদেরও ডিএনএ পরীক্ষা করছে এই ল্যাবরেটরি। নিকটাত্মীয়ের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব আত্মীয়ের সূত্র ধরেই মৃত ব্যক্তি শনাক্ত হবে। তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ সূত্র জানিয়েছে, কোন কবরে কে আছেন, তা জানার জন্য আড়াই থেকে তিন মাস অপেক্ষা করতে হবে।
রানা প্লাজা ধসের ছয় দিন পর ৩০ এপ্রিল আত্মীয় শনাক্ত করার জন্য প্রথম রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এ পর্যন্ত আত্মীয় দাবি করে ৫৫৩ জন রক্তের নমুনা পরীক্ষার জন্য দিয়েছেন। শরীফ আক্তারুজ্জামন বলেন, এর মধ্যে মৃত ১৪০ জনের ও আত্মীয়দের ৪৩২ জনের ডিএনএ বিশ্লেষণ শেষ হয়েছে। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে নমুনা বিশ্লেষণ শেষ হবে।
ল্যাবরেটরির কর্মকর্তারা বলছেন, ডিএনএ বিশ্লেষণ শেষে তথ্য মেলানোর (ডিএনএ ম্যাচিং) জন্য বিশেষ সফটওয়্যার দরকার। সফটওয়্যারের ব্যাপারে সহযোগিতার জন্য মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) একটি প্রতিনিধিদল আগামী মাসের শেষের দিকে বাংলাদেশ সফর করবেন। সফটওয়্যারটি পাওয়া গেলে আগামী অক্টোবরের মধ্যে মৃত ব্যক্তিদের পরিচয় জানা যাবে।

অজ্ঞাত লাশগুলোকে পরিচয় দেওয়ার চেষ্টায় ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবরেটরির গবেষকেরা। গত বৃহস্পতিবার ছবিটি তুলেছেন মনিরুল আলম
অজ্ঞাত লাশগুলোকে পরিচয় দেওয়ার চেষ্টায় ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবরেটরির গবেষকেরা। গত বৃহস্পতিবার ছবিটি তুলেছেন মনিরুল আলম

গত বছর এই ল্যাবরেটরিতে তাজরীন পোশাক কারখানায় আগুনে পুড়ে শ্রমিক মারা যাওয়ার ঘটনায় ৫৯ জনের ডিএনএ বিশ্লেষণ করা হয়। তখন আত্মীয় দাবি করে ৭৩ জন রক্ত দিয়েছিলেন ডিএনএ পরীক্ষার জন্য। ওই পরীক্ষায় ৪৭ জনের পরিচয় নিশ্চিত হতে পেরেছিল সরকার।
ডিএনএ রূপরেখা: ডিএনএ রূপরেখা (ডিএনএ প্রোফাইল) হচ্ছে মানুষের বংশগতির চিত্র। এটা সংখ্যায় প্রকাশ করা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজের বংশগতির চিত্র পেতে ১৬টি নির্দেশক (এসটিআর মার্কার) ব্যবহার করা হয়।
অজ্ঞাত ব্যক্তির ডিএনএ রাসায়নিক বিশ্লেষণ করলে একটি নির্দেশকের বিপরীতে দুটি পৃথক সংখ্যা পাওয়া যায়। একটি সংখ্যা একটি বৈশিষ্টের পরিচয় বহন করে। ১৬টি নির্দেশক থেকে ৩২টি সংখ্যা পাওয়া যায়। এই ৩২টি সংখ্যাই ব্যক্তির ডিএনএ রূপরেখা।
একইভাবে আত্মীয়ের দাবিদার ব্যক্তির ডিএনএ রাসায়নিক বিশ্লেষণ করে ৩২টি সংখ্যা পাওয়া যায়। এরপর অজ্ঞাত ব্যক্তির ৩২টি সংখ্যা এবং আত্মীয়ের ৩২টি সংখ্যা পাশাপাশি রেখে তুলনা করা হয়। সংখ্যাগুলো একই হলে নিকটাত্মীয় প্রমাণিত হয়।
ডিএনএ (ডি-অক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড) হচ্ছে প্রতিটি জীবের বংশগতির ধারক ও বাহক। কোষের অভ্যন্তরে থাকে নিউক্লিয়াস। নিউক্লিয়াসে থাকে ক্রোমোজোম। এই ক্রোমোজোম গঠিত ডিএনএ দিয়ে। আর জিন হলো ডিএনএর একটি নির্দিষ্ট অংশ, যা নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য যেমন, চোখের রং, চুলের রং ইত্যাদির জন্য দায়ী।