পরিবারের শেষ ভালোবাসাটুকুও জুটছে না

হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন সবচেয়ে বেশি। থামেনি নারী কর্মীদের অস্বাভাবিক মৃত্যু এবং আত্মহত্যাও।

স্ট্রোক করে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ইরাকে মারা যান প্রবাসী বাংলাদেশি মো. সগির। ৯ দিন পর দেশে থাকা তাঁর ভাই মো. খবির লাশ দেশে আনতে আবেদন করেন ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডে। এরপর বোর্ডে নিয়মিত আসা-যাওয়া করছেন। ওয়েজ আর্নার্স বোর্ড থেকে তাঁকে বলা হয়েছে, নিয়োগকর্তা খরচ দিচ্ছেন না, তাই ইরাকেই তাঁকে দাফন করতে হবে। ইরাকের মর্গে ৯ মাস ধরে পড়ে আছে সগিরের লাশ। কিন্তু কিছুতেই ভাইয়ের লাশ বিদেশে দাফন করতে রাজি নয় পরিবার। ভাই মো. খবির প্রথম আলোকে বলেন, ভাইয়ের মুখটা একবার দেখতে চান, নিজেরা ভাইয়ের লাশ দাফন করতে চান। এটাই এখন পরিবারের একমাত্র চাওয়া।

প্রতিবছরই প্রবাসে মারা যাওয়া কিছু বাংলাদেশির লাশ কর্মস্থলের দেশটিতে দাফন করা হয়। তবে অধিকাংশ মৃতদেহ দেশে নিয়ে আসা হয়। করোনা মহামারিতে বদলে গেছে পরিস্থিতি। আগের বছরের চেয়ে প্রবাসে মৃত্যু বেড়েছে। কিন্তু লাশ আনা কমে গেছে। কয়েক মাস ধরে স্বাভাবিক ফ্লাইট চলাচল বন্ধ। বিশেষ ফ্লাইটে আনার খরচ বহন নিয়ে রয়েছে নানা অনিশ্চয়তা। প্রিয় স্বজনকে শেষবিদায় জানাতে না পারার সীমাহীন কষ্ট প্রবাসী পরিবারগুলোতে।

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, প্রবাসে সব মৃত্যুর তথ্য তাঁদের কাছে থাকে না। যাঁরা সহায়তা চেয়ে বোর্ডে আবেদন করেন, তাঁদের তথ্য থাকে। আর দেশে আসা লাশের হিসাব আছে বোর্ডের কাছে। এতে দেখা যায়, গত বছর দেশে এসেছিল ৩ হাজার ৬৫৮টি লাশ। আর এ বছর অক্টোবর পর্যন্ত দেশে এসেছে ২ হাজার ৪৯৬টি লাশ। এর মধ্যে সর্বশেষ অক্টোবর মাস এসেছে ৩৩২টি। সবচেয়ে বেশি লাশ এসেছে সৌদি আরব ও মালয়েশিয়া থেকে।

প্রবাসীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কর্মী থাকেন সৌদি আরবে। মৃত্যুও এ দেশটিতে বেশি। তাই সৌদি আরবের তথ্য অনুসন্ধান করেছে প্রথম আলো। সৌদির রাজধানী রিয়াদের বাংলাদেশ দূতাবাস ও জেদ্দা কনস্যুলেট কার্যালয় থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, সৌদি আরবে গত বছর মারা গেছেন ১ হাজার ৮৭০ প্রবাসী। আর এ বছর মৃত্যু বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। বছরের প্রথম ১০ মাসেই মারা গেছেন ৩ হাজার ৬৫৬ জন। গত বছর ২৭ শতাংশ কর্মীর দাফন হয়েছে সৌদি আরবে। আর এবার ৮১ শতাংশের দাফন হয়েছে দেশটিতে। প্রবাসীদের মৃত্যুর কারণ নিয়ে দূতাবাসের কর্মকর্তারা বলছেন, হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন সবচেয়ে বেশি। এরপর বেশি মারা গেছেন করোনায় আক্রান্ত হয়ে। এ বছর দেশটিতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৯৫৯ জন। থামেনি নারী কর্মীদের অস্বাভাবিক মৃত্যু এবং আত্মহত্যা।

প্রতিবছরই প্রবাসে মারা যাওয়া কিছু বাংলাদেশির লাশ কর্মস্থলের দেশটিতে দাফন করা হয়। তবে অধিকাংশ মৃতদেহ দেশে নিয়ে আসা হয়। করোনা মহামারিতে বদলে গেছে পরিস্থিতি। আগের বছরের চেয়ে প্রবাসে মৃত্যু বেড়েছে। কিন্তু লাশ আনা কমে গেছে। কয়েক মাস ধরে স্বাভাবিক ফ্লাইট চলাচল বন্ধ। বিশেষ ফ্লাইটে আনার খরচ বহন নিয়ে রয়েছে নানা অনিশ্চয়তা।

মারা যাওয়া প্রবাসীদের লাশ দেশে আনতে না পারা নিয়ে সৌদি দূতাবাসের দুই কর্মকর্তা বলেন, সৌদি আরবে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের লাশ স্থানীয় পর্যায়ে দাফন করতে গত মার্চেই নির্দেশনা দেয় সৌদির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের লাশ দ্রুত সংশ্লিষ্ট এলাকায় দাফন করা বাধ্যতামূলক। আর যাঁরা অন্য জটিলতায় মারা যাচ্ছেন, তাঁদেরও দ্রুত দাফনের কথা বলা হয়েছে। বাণিজ্যিক ফ্লাইট বন্ধ থাকায় মর্গে এত লাশ রাখা সম্ভব নয় বলেই এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে লাশ বিমানে তোলার নিশ্চয়তা দিলে দেশে আনার অনুমতি পাওয়া যায়। ফ্লাইটের অভাবে এটি সব সময় করা সম্ভবও হচ্ছে না।

লাশ দেশে আনবে কে

প্রবাসীদের লাশ দেশে আনা নিয়ে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের পরিচালক শোয়াইব আহমাদ খান প্রথম আলোকে বলেন, লাশ পরিবহনের খরচ দেওয়ার বিষয়টি কল্যাণ বোর্ডের নীতিমালায় নেই। এর জন্য আলাদা তহবিলও নেই। প্রবাসী কর্মীদের নিয়োগকর্তা এ খরচ বহন করেন। তবে প্রবাসী কর্মীর পরিবারের আবেদনের ভিত্তিতে বোর্ড থেকে বিশেষ অনুমোদন নিয়ে প্রতিবছর কিছু লাশ আনার খরচ বহন করে কল্যাণ বোর্ড। তিনি জানান, গত চার মাসে ১ হাজার ৮৩৬ জন মৃত প্রবাসীর পরিবারকে তিন লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে।

আগে প্রবাসী কর্মীর লাশ বিনা পয়সায় পরিবহন করত বাংলাদেশ বিমান। এ বছর তারা এ সেবা বন্ধ করে দিয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড। এ কারণেও প্রবাসীর লাশ আনার ক্ষেত্রে নতুন জটিলতা তৈরি হয়েছে।

বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোকাব্বির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বছরে কয়েক শ লাশ আনতে গিয়ে কোটি কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বিমান তো ঋণ নিয়ে বিনা পয়সায় এমন সেবা দিতে পারে না। এটি প্রবাসী মন্ত্রণালয় ও কল্যাণ বোর্ডের দায়িত্ব। প্রবাসীদের জমানো টাকা আছে তাদের তহবিলে।

সকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে

মৌলভীবাজারের ২৪ বছর বয়সী ফায়াজ মিয়া কাজ করতেন ওমানের এক সবজিবাগানে। হঠাৎ গত ১২ আগস্ট মারা যান তিনি। কাগজপত্রে মৃত্যুর কারণ লেখা আছে ‘স্বাভাবিক’। ১৩ সেপ্টেম্বর দেশে আসে তাঁর লাশ। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) স্থানীয় কার্যালয়ে গেলে পরিবারের সদস্যদের জানানো হয়, সরকারি তত্ত্বাবধানে লাশ আনতে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। তাঁর ভাই রেনু মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, লাশ আনতে অনেক কষ্ট হয়েছে। ঋণ করে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা ব্যয়ে দালালের মাধ্যমে লাশ এনেছেন।

বছরে কয়েক শ লাশ আনতে গিয়ে কোটি কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বিমান তো ঋণ নিয়ে বিনা পয়সায় এমন সেবা দিতে পারে না। এটি প্রবাসী মন্ত্রণালয় ও কল্যাণ বোর্ডের দায়িত্ব। প্রবাসীদের জমানো টাকা আছে তাদের তহবিলে।
মোকাব্বির হোসেন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাংলাদেশ বিমান

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইসরাইল ভূঁইয়া গত ২৩ সেপ্টেম্বর ইরাকে মারা যান। লাশ দেশে আনতে পরদিন তাঁর পরিবার আবেদন করে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডে। একই দিনে নিয়োগকর্তার খরচে লাশ দেশে পাঠাতে ইরাকে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সেলরকে চিঠি পাঠায় কল্যাণ বোর্ড। এর উত্তরে ২৮ সেপ্টেম্বর দূতাবাস থেকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, মৃত্যুর তিন মাস আগে ইসরাইল চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন, সর্বশেষ নিয়োগকর্তার কাছ থেকে খরচ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কল্যাণ তহবিলেও টাকা নেই। তাই দেশ থেকে টাকা পাঠানো ছাড়া লাশ পাঠানো সম্ভব হবে না।

মৃত ইরাইলের বাবা আবদুস সাত্তার কাঁদতে কাঁদতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছরের জুনে ইরাকে গেল পোলাডা। এরপর হঠাৎ করেই মৃত্যুর খবর পাইলাম। এখন নিজের সন্তানের মুখটা শেষবারের মতোন দেখতে চাই। নিজে দাফন করতে চাই।’

মৃত প্রবাসীদের স্বজনেরা বলছেন, করোনাকালে প্রবাসে চাপ ও বিপদ দুটিই বেড়েছে। কিন্তু দেশের সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো সুবিধা বা সান্ত্বনা কিছুই পাচ্ছেন না তাঁরা।

এ বিষয়ে অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, অস্বাভাবিক মৃত্যু প্রতিবছরই হয়। করোনার মতো দুর্যোগে এটি ভয়াবহভাবে বেড়ে গেছে। চাকরি হারানো, খাবার ও চিকিৎসাসংকট, দুশ্চিন্তা-উদ্বেগ এবং করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন প্রবাসীরা। প্রবাসীর মৃত্যু প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং পরিবার চাইলে লাশ দেশে আনা সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। একই সঙ্গে মৃত কর্মীর পরিবারের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।