পলির বিপদে পায়রা বন্দর

পটুয়াখালীতে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের কাছে পায়রা বন্দরের প্রথম টার্মিনাল মাথা তুলছে। সেই পর্যন্ত জাহাজ ঢোকার জন্য ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেলের পলি খননের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। এর জন্য ব্যয় হবে আট হাজার কোটি টাকা। কিন্তু আন্তর্জাতিক একটি সমীক্ষা বলছে, এই নৌপথ পলিমুক্ত রাখা দুঃসাধ্য হবে।

জার্মানি, বেলজিয়াম ও বাংলাদেশের পাঁচ গবেষকের করা এই সমীক্ষা বলছে, যেকোনো সময় মাঝারি মাত্রার একটি ঝড়ে পলি পড়ে চ্যানেলটি বন্ধও হয়ে যেতে পারে। এমনিতেই নিয়মিত জোয়ার-ভাটায় চ্যানেলটি প্রতিবছর পলিতে ভরে যায়। একবার ভরাট হলে খনন করতে ৮ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা লাগবে।

গবেষক দলটি বলছে, উন্নত কোনো দেশের পক্ষেও এ ধরনের ব্যয়বহুল খননকাজ নিয়মিত পরিচালনা করা সম্ভব নয়। আর একবার ভরাট হলে খনন শেষ না হওয়া পর্যন্ত বন্দরের সব কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হবে। পায়রা দেশের তৃতীয় সমুদ্রবন্দর হতে যাচ্ছে।

বেলজিয়ামভিত্তিক প্রতিষ্ঠান জান ডি লুন ও পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের যৌথ উদ্যোগে স্থাপন করা একটি কোম্পানিকে ওই চ্যানেল খননের দায়িত্ব দিয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। গত জানুয়ারি মাস থেকে খননের সমীক্ষাসহ অন্যান্য কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু ওই পাঁচ গবেষক বলছেন, হিমালয় থেকে বছরে ১১০ কোটি কিউবিক মিটার পলি বাংলাদেশের নদীগুলো দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ে। এর মধ্যে পায়রা নদীর ওই চ্যানেলের আশপাশের এলাকায় বছরে ৪০ কোটি কিউবিক মিটার পলি জমা হয়। নিয়মিত জোয়ার-ভাটায়ই তা বন্দরের চ্যানেলকে এক বছরের মধ্যে ভরাট করে দেবে।

নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী অবশ্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘যমুনা সেতু থেকে পদ্মা সেতু পর্যন্ত যতগুলো বড় প্রকল্প আওয়ামী লীগ নিয়েছে, প্রতিবারই একদল বিশেষজ্ঞ এসে সেসব বিষয়ে নানা নেতিবাচক বক্তব্য তুলে ধরেছেন। অথচ পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ এখন শেষ হওয়ার পথে, পায়রা বন্দরের ক্ষেত্রেও আমরা একইভাবে সফল হব। কারণ, আমরা যাচাই-বাছাই না করে কোনো প্রকল্প চূড়ান্ত করিনি।’ তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের চ্যানেলেও অনেক পলি পড়ে। তা খনন করেই আমরা বন্দর সচল রেখেছি। আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের ব্যাপারে তো কারও হাত নেই। তবে পায়রায় পলির সমস্যা নিয়ে যদি কারও ভিন্নমত থাকে, তাকে অবশ্যই আমরা আমলে নেব।’

গবেষক দলটির নেতৃত্বে রয়েছেন জার্মান সরকারের ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান ও বর্তমানে জার্মানির ব্রেহম্যান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হারমান আর কুদরাস। সদস্যরা হচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার, বেলজিয়ামের জেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আই মেয়ের, জার্মানির ব্রেহম্যান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এল পালামেনাচি ও হামবোল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বি মাচালেট।

এই গবেষণার ফলাফল গত ১১ ও ১২ জানুয়ারি রাজধানীতে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল নেটওয়ার্কের (বেন) যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত ‘বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০’ শীর্ষক সম্মেলনে উপস্থাপন করা হয়। সেখানে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ভূতত্ত্ববিদ, গবেষক ও পরিবেশবাদীরা উপস্থিত ছিলেন। সরকারকে ওই সম্মেলনের সারবস্তু ও সুপারিশ দেওয়া হয়েছে। সেখানে পায়রা বন্দরের পলির বিপদের বিষয়টি উল্লেখ আছে।

পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমোডর এম জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই গবেষক দল যে আশঙ্কার কথাগুলো বলেছে, সে সম্পর্কে আমরা অবগত। এর বাইরে আমরা আরও বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত জোগাড় করছি। পলির বিপদ কাটিয়ে বন্দর চালু রাখার উপায়ও আমরা বের করছি। আশা করি, ২০২২ সালের মধ্যে আমরা পায়রা বন্দর চালু করতে পারব।’

অধ্যাপক কুদরাস বঙ্গোপসাগরের পলি ও পানির প্রবাহ নিয়ে ২০ বছর ধরে গবেষণা করছেন। ২০১২ সালে বাংলাদেশ মিয়ানমার ও ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে সমুদ্রসীমা জয় করে। ওই লড়াইয়ে বাংলাদেশ দলের দুজন আন্তর্জাতিক উপদেষ্টার একজন এই অধ্যাপক কুদরাস। ২০১১ সালে তাঁর করা গবেষণার তথ্য-উপাত্ত বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণবিষয়ক মামলায় আদালতে উপস্থাপন করে বাংলাদেশ। ওই মামলায় বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের বিরোধপূর্ণ ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকা পায়।

কুদরাস বলছেন, শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের যতগুলো উপকূলীয় এলাকা আছে, তার মধ্যে পটুয়াখালীর পায়রা এলাকায় সবচেয়ে বেশি পলি জমা হয়। সেখানে সমুদ্রবন্দর করলে তা কোনোভাবেই নিয়মিত চালু রাখা সম্ভব হবে না। একই সঙ্গে এই বন্দর চালু হলে একে কেন্দ্র করে ওই এলাকায় শিল্পকারখানা ও নানা অবকাঠামো গড়ে উঠবে। ইতিমধ্যে সেখানে অনেকগুলো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে। সেখানে পণ্য পরিবহন ওই বন্দরের মাধ্যমে শুরু হলে এবং তা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলে বাংলাদেশ বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে।

পায়রা বন্দরকে কেন্দ্র করে সরকার চীনের সঙ্গে দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। ইতিমধ্যে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ শেষের পথে। কলাপাড়া উপজেলাতেই সরকারি উদ্যোগে মোট ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্র, একটি সমুদ্রবন্দর, বিশেষ শিল্পাঞ্চল ও চার লেনের মহাসড়ক নির্মাণের কাজ চলছে। দেশের বেশ কয়েকটি কোম্পানি কলাপাড়া ও কুয়াকাটা এলাকায় শিল্পকারখানা করার জন্য জমি কিনেছে।

সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ও জ্যেষ্ঠ সচিব শামসুল আলম বদ্বীপ পরিকল্পনা সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন। পায়রা বন্দর নিয়ে উপস্থাপন করা এসব তথ্যের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যেকোনো বিশেষজ্ঞ যেকোনো বিষয় নিয়ে তাঁর মত তুলে ধরতে পারেন। তার মানে এটাই যে চূড়ান্ত তেমনটা নয়। আমরা সবকিছু যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেব।’

পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, বন্দরটি বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার ও চীনের সামুদ্রিক করিডর হিসেবে কাজ করবে। এ ছাড়া এলএনজি টার্মিনাল, সার কারখানা, তৈরি পোশাক, ওষুধশিল্পসহ সব ধরনের ভারী শিল্পকারখানা স্থাপনের জন্য পায়রা এলাকাটি আকর্ষণীয় স্থান হয়ে উঠবে। জাহাজ নির্মাণশিল্পগুলো ওই এলাকায় চলে আসবে বলেও পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ আশা করছে।

গত জানুয়ারিতে পায়রা বন্দরের মূল খননকাজের জন্য বেলজিয়ামের কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে সরকার। চুক্তি অনুযায়ী সমীক্ষার জন্য ১৪ মাস এবং খননের জন্য ১৪ মাস সময় লাগবে। এরপর ৬ মাস প্রাথমিক রক্ষণাবেক্ষণ খনন এবং ৯ বছর ২ মাস রক্ষণাবেক্ষণ খনন করা হবে।

খনন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বেলজিয়াম এক্সপোর্ট ক্রেডিট এজেন্সির সহায়তায় এইচএসবিসি এবং এর কনসোর্টিয়াম ব্যাংক থেকে পায়রা ড্রেজিং কোম্পানি লিমিটেড গ্রহণ করবে। পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রাথমিক রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং শেষ হওয়ার ৬ মাস পর থেকে ওই অর্থ ২০টি সমপরিমাণ অর্ধবার্ষিক কিস্তিতে সুদসহ পরিশোধ করবে। চুক্তির বাকি বছরগুলোতে রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিংয়ের জন্য উভয় পক্ষ অর্থায়নের উৎস খুঁজবে এবং অর্থপ্রাপ্তি সাপেক্ষে রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং করবে।

২০১৩ সালের নভেম্বরে সরকার ১ হাজার ১২৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ব্যয়ে পায়রা বন্দরের প্রথম টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শুরু করে। ২০১৮ সালের জুনের মধ্যে তা শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গত বছরের মার্চে ওই টার্মিনাল নির্মাণের ব্যয় প্রায় দুই গুণ বাড়িয়ে ৩ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা এবং সময় আরও দুই বছর বাড়ানো হয়। আর চ্যানেল খননের জন্য গত জানুয়ারিতে চুক্তি হয়। আগামী ৩৪ মাসে তা শেষ হবে বলে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে।

অধ্যাপক কুদরাসের গবেষণা অনুযায়ী বঙ্গোপসাগর থেকে পায়রা বন্দরে একটি জাহাজকে ভিড়তে হলে মোট ৬০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে। ওই পথের ২৪ কিলোমিটারে ৫ মিটার, ২২ কিলোমিটারে ১০ মিটার ও ১৪ কিলোমিটারে ১৫ মিটার গভীরতা রয়েছে। তবে জাহাজ চলাচল নির্বিঘ্ন করতে নৌপথটিতে গড়ে ১৫ মিটার গভীর ও ৩০০ মিটার প্রস্থ থাকতে হবে। এ জন্য ১০ কোটি কিউবিক মিটার পলি খনন করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একটি গভীর সমুদ্রবন্দর দরকার। কিন্তু এ ধরনের বন্দরের জন্য সমুদ্রের মহিসোপান ১৫ মিটার পর্যন্ত গভীরতা দরকার। একই সঙ্গে সেখানে পলির প্রবাহ কম থাকতে হবে, যাতে রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কম হয়। এই অবস্থা পায়রায় নেই। এ ছাড়া পায়রা বন্দরের জন্য নির্ধারিত স্থানটির ভূতাত্ত্বিক গঠন এখনো বেশ অস্থির। অর্থাৎ সেখানে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। এমন একটি স্থানে এই বন্দর নির্মাণ ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি বলেন, শুরুতে কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপে বন্দর স্থাপনের যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সেটাই ছিল সবচেয়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত।