পাঠ্যবইয়ে নারী এখনো মিসেস, কুটিল, দুর্বল

নারীর পরিচিতি এখনো ‘মিসেস’ শব্দের বেড়াজাল থেকে বের হতে পারেনি। একইভাবে পুরুষ ড. বা জনাব, আর নারীদের ‘বেগম’, ‘স্ত্রীলোক’, ‘গৃহবধূ’ হিসেবে সম্বোধন করাই যায়। নারী কোমল, দুর্বল, কুটিল। তাঁরা কঠোর পরিশ্রম করতে পারেন না। তাঁরা আবেগপ্রবণ। তাঁরা ‘হাউস ওয়াইফ’। অন্যদিকে পুরুষ কঠোর এবং পরিশ্রমী। খেলাধুলা পুরুষের ব্যাপার। লেখক, কবি, পুলিশ, কৃষক, উদ্ভাবক বা গবেষক, বৈমানিক, সংবাদপত্রের পাঠক, টেলিভিশনে খবরের দর্শক, উচ্চ আদালতের প্রধান, সাংসদও পুরুষ। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি একজন পুরুষ, তিনি হলেন বাবা। আর গৃহস্থালি, সে তো নারীর কাজ।
ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) মোট ২৮টি (ঐচ্ছিক বিষয় থেকে চারটি) পাঠ্যপুস্তক নিয়ে ‘জেন্ডার সংবেদনশীলতা ও প্রজননস্বাস্থ্য ২০১৩ সালে মাধ্যমিক শ্রেণীতে পাঠ্যবইয়ের বিষয় বিশ্লেষণ’ শীর্ষক গবেষণায় নারী ও পুরুষের এ ধরনের উপস্থাপনই দেখা গেছে। গবেষণাটি করেছে বেসরকারি সংগঠন ‘বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ’।
ষষ্ঠ শ্রেণীর বৌদ্ধ ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বইয়ে মা, ছেলে ও ছেলের স্ত্রী—এই তিনটি মূল চরিত্রের গল্পে ছেলের স্ত্রী ‘কুটিল’, সে হিংসার কারণে শাশুড়িকে ঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য করে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
একই শ্রেণীর শারীরিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বইটিতে মেয়েদের শারীরিক পরিবর্তন বলতে ‘ঋতুস্রাব শুরু হওয়া, ঊরু ও নিতম্ব ভারী হওয়া, বুক বড় হয়ে ওঠা’ কথাগুলো বলা হয়েছে। একইভাবে ‘যৌন বিষয়ে চিন্তা আসে এবং বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বাড়ে’ বলে বলা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের বিষয়গুলো জানানো জরুরি হলেও আরও শোভন ভাষায় বিষয়গুলো উপস্থাপন করা যেত বলে গবেষকেরা মত দিয়েছেন।
গবেষণার মুখ্য গবেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস প্রথম আলোকে বলেন, নারী প্রগতি সংঘ ধারাবাহিকভাবে এ ধরনের গবেষণা করছে। সে অভিজ্ঞতায় বলা যায়, পাঠ্যপুস্তকে জেন্ডার, প্রজননস্বাস্থ্যসহ অন্যান্য বিষয়ে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। তবে এখনো পাঠ্যপুস্তককে পুরোপুরি জেন্ডার সংবেদনশীল বা শিশুবান্ধব বলার উপায় নেই।
গবেষণা অনুযায়ী, সপ্তম শ্রেণীর খ্রিস্ট ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বইয়ে বলা হয়েছে, পুরুষের দেহ তুলনামূলকভাবে শক্ত, কঠোর। কিন্তু নারীর দেহ কোমল। তাঁরা আবেগপ্রবণ। মেয়েরা নির্বোধ, গোপন কথা গোপন রাখতে পারেন না। বইয়ে ব্যভিচার, কামুকতা, যৌন বাসনা, যৌন অনাচার, যুবতী শব্দগুলো অশোভনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।
সপ্তম শ্রেণীর ইংলিশ গ্রামার অ্যান্ড কম্পোজিশন বইয়ে পুরুষের পরিচিতির আগে ‘ড.’ আর নারীর নামের আগে ‘মিসেস’ ব্যবহার করা হয়েছে। ছেলের উদাহরণে শিক্ষক আর মেয়ের উদাহরণে ‘হাউস ওয়াইফ’ উল্লেখ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান তানিয়া হক বলেন, ‘আমার স্কুলপড়ুয়া মেয়ে অনেক সময়ই বলে এই কাজ তোমার করা উচিত না। তাকে কিন্তু পুরুষের কাজ কোনটা আর নারীর কাজ কোনটা তা কখনো শেখানো হয়নি। সে পাঠ্যপুস্তক, টেলিভিশনসহ সমাজের বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিয়ত যা দেখছে তা-ই শিখছে। সমাজের সর্বত্র জেন্ডার বৈষম্যের চিত্র দেখে দেখেই তারা বড় হচ্ছে। অন্যদিকে যাঁরা পাঠ্যপুস্তক রচয়িতা, তাঁরা নারী বা পুরুষ যা-ই হোন কেন, তাঁরাও এই সমাজেরই অংশ। তাঁদের অনেকেরও জেন্ডার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেই বা তাঁরা সচেতন নন। এ কারণে শিশুরা পরিপূর্ণভাবে কিছু শিখতে পারছে না।’
২৮টি পাঠ্যপুস্তক নিয়ে করা এই গবেষণায় আধেয় বিশ্লেষণ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। শারীরিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য, বিভিন্ন ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা, গার্হস্থ্যবিজ্ঞান, কৃষি শিক্ষাসহ বইগুলোর লেখা, ছবি, গ্রাফিকস, ইলাস্ট্রেশনসহ সবকিছু বিশ্লেষণ করা হয়েছে। গবেষণায় নারী-পুরুষ বৈষম্যের চেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে নারীর প্রতি বিদ্যমান বৈষম্যের ওপর।
গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত এ ২৮টি পাঠ্যপুস্তক রচনা ও সম্পাদনায় ৩৫ জন নারী জড়িত ছিলেন, অন্যদিকে পুরুষের সংখ্যা ১০৪ জন। ২৮টির মধ্যে সাতটি বইয়ের রচনা ও সম্পাদনায় নারীর উপস্থিতি শূন্য। পাঠ্যপুস্তকগুলোর প্রচ্ছদ ও চিত্রাঙ্কনে পুরুষ ছিলেন ৭০ জন, আর নারী ছিলেন মাত্র দুজন।
ইতিবাচক ও নেতিবাচকতার মিশেল
ষষ্ঠ শ্রেণীর কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষা বইটির প্রচ্ছদের তিনটি ছবির মধ্যে একটিতে নারী পড়ছেন এবং আরেকটিতে নারীকে সাইকেলচালক হিসেবে দেখানো হয়েছে। বিছানা গোছানো, কাপড় পরিষ্কার এবং ঝাড়ু হাতে পুরুষকে উপস্থাপন করা হয়েছে। মায়েদের গৃহস্থালি কাজের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পাশাপাশি বেগম রোকেয়ার শিক্ষাজীবন উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এ বইটিতেই কায়িক ও মেধাশ্রমের ক্ষেত্রে নারী অনুপস্থিত। সৃজনশীল মানুষের গল্পে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ যাঁদের নাম আছে, তাঁরা সবাই পুরুষ। তার পরও বইটির বিভিন্ন উপস্থাপনকে গবেষণায় ইতিবাচক বলা হয়েছে।
ষষ্ঠ শ্রেণীর বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি বইটিতে বক্তা ও শ্রোতা বোঝাতে দুজন পুরুষের মুখের ছবি দেওয়া হয়েছে। মহত্ সাহিত্যিকদের তালিকায় কোনো নারী লেখকের কথা উল্লেখ করা হয়নি। বইটিতে পুরুষের প্রাধান্য রয়েছে। এমনকি সড়কের নামের ক্ষেত্রে পুরুষের নামে যেসব সড়ক আছে, সেগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। বইটিতে সারাংশ ও সারমর্মে মা-মরা মেয়ে মিনুকে বোবা, কালা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বোবা হওয়ায় নীরবে সে কাজ করতে পারে। এসব কারণে মিনুকে ‘সর্বগুণান্বিতা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ক্রিকেট খেলায় ছবি ও বর্ণনা পুরুষনির্ভর। মেয়েরাও যে ক্রিকেট খেলে তা উল্লেখ করা হয়নি। বইটিতে ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’ শুধু এ কথাটিতেই নারীর ইতিবাচক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
ষষ্ঠ শ্রেণীর বৌদ্ধ ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বইটিতে উপাসক-উপাসিকা হিসেবে নারী-পুরুষের চরিত্র আছে। পুত্রসন্তানের জন্মের খবর পেয়ে সিদ্ধার্থের সংকল্প, ‘শ্রমণ গৌতম ও ছাগশিশু’ অংশে পুত্রসন্তান কামনায় এক রাজার ছাগ বলি দেওয়া, রাজকুমারকে সংসারমুখী করার জন্য বিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
ষষ্ঠ শ্রেণীর শারীরিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বইটিতে ব্যায়ামের ছবিতে মেয়ে আছে, তবে অপেক্ষাকৃত কঠিন ব্যায়ামে ছেলের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে।
সপ্তম শ্রেণীর কৃষি শিক্ষা বইয়ে সামাজিক বৈঠকের ছবিতে বক্তার আসনে নারীর ছবি দেওয়া হয়েছে। তবে বইটিতেই ব্যবসা বা কৃষি পুরুষদের জন্য আর হালকা গোছের কাজ মুরগি পালন নারীর জন্য—এ রকম ধারণাও দিচ্ছে।
নবম-দশম শ্রেণীর ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বইয়ে ‘নারীর প্রতি সম্মানবোধ’ শিরোনামের পাঠটি জেন্ডার সংবেদনশীলতার বিচারে ইতিবাচক। তবে এ বইতেই আদর্শ জীবন চরিত্রে নারী অনুপস্থিত।
নবম-দশম শ্রেণীর গণিত বইয়ে পিতা-পুত্রের বয়স-সংক্রান্ত অঙ্কের পাশাপাশি মাতা-কন্যার বয়স-সংক্রান্ত অঙ্কও রাখা হয়েছে। একই শ্রেণীর বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা বইয়ে নবজাগরণ ও সংস্কার আন্দোলন, বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
নবম-দশম শ্রেণীর জীববিজ্ঞান বইয়ে মানবদেহের বিভিন্ন তন্ত্রের বর্ণনাসহ বিভিন্ন উদাহরণে পুরুষের প্রাধান্য থাকলেও কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার পেছনে যে পুরুষের ভূমিকাই প্রধান, তা তুলে ধরা হয়েছে। মাদকদ্রব্যের কুফল, এইচআইভি-এইডস, অটিজমসহ বিভিন্ন বিষয়ের ইতিবাচক বর্ণনাও বিভিন্ন বইয়ে স্থান পেয়েছে।