পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু সবচেয়ে বেশি

পানিতে খেলতে নেমে প্রতিবছর অনেক শিশুর মৃত্যু ঘটে  ছবি: মুসলিমা জাহান
পানিতে খেলতে নেমে প্রতিবছর অনেক শিশুর মৃত্যু ঘটে ছবি: মুসলিমা জাহান

ভরা বর্ষায় বিলজুড়ে লাল-সাদা শাপলা। লতিফা আর রমিজ চুপি চুপি জেলেবাবার মাছ ধরার নৌকা নিয়ে বিলে যায় শাপলা তুলতে। রমিজ ছোট ছোট হাতে বইঠা ধরে আর লতিফা শাপলা তুলে নৌকা ভর্তি করে। ডুবে থাকা একটি গাছের গুঁড়ির ধাক্কায় হঠাৎ উল্টে যায় নৌকা। সাত বছরের রমিজ অনেক চেষ্টায়ও কিছু করতে পারে না। রমিজ সাঁতার জানলেও চার বছরের লতিফাকে পানি গ্রাস করে। সাঁতার না-জানা লতিফা সারা জীবনের পানি একসঙ্গে খেয়ে নেয়। যেখানে শাপলাভর্তি নৌকা নিয়ে বাড়ি ফেরার কথা, সেখানে অন্য এক জেলের সহায়তায় বোনের মৃতদেহ নিয়ে বাড়ি ফেরে রমিজ। ঘটনাটি ঘটে ২০১১ সালের এক বর্ষার দিনে বরিশালের উজিরপুর উপজেলার কালবিলা বিলে।লতিফার মতো এ রকম হাজার হাজার শিশু প্রতিবছর পানিতে ডুবে মারা যায়। বাংলাদেশে প্রতি ৩০ মিনিটে একটি শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। আর দিন শেষে মৃত শিশুর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৫০। উদ্বেগের বিষয়, সে সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ হেলথ অ্যান্ড ইনজুরি সার্ভে (বিএইচআইএস-২০০৫) প্রতিবেদন অনুযায়ী, অন্য যেকোনো কারণে মৃত্যুর চেয়ে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। অর্থাৎ, শিশুমৃত্যুর প্রধানতম কারণ পানিতে ডোবা। বাংলাদেশে প্রতিবছর এক থেকে ১৭ বছর বয়সী কমপক্ষে ১৮ হাজার শিশুর পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়। মারা যাওয়া বেশির ভাগ শিশুর বয়স ১০ মাস থেকে দুই বছরের মধ্যে। এরা মূলত পরিবারের অপর্যাপ্ত তত্ত্বাবধানের অভাবে দুর্ঘটনার শিকার হয়। তবে পাঁচ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মৃত্যু হয় সাঁতার না জানার কারণে। আর বছরে পানিতে ডুবে মারা যাওয়া মোট মানুষের সংখ্যা প্রায় ২২ হাজার।প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে এবং খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধু সাঁতার না জানার কারণেই বেশির ভাগ শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। সাধারণত দুর্ঘটনাগুলো ঘটে সকাল নয়টা থেকে বেলা দুইটার মধ্যে। এ সময় মায়েরা সাংসারিক কাজে ব্যস্ত থাকেন। ছেলেমেয়ের খোঁজ নেওয়া হয় না। এ কারণে এক থেকে চার বছর বয়সী শিশুরাই বেশি এ দুর্ঘটনার শিকার হয়। ওরা সাঁতার জানে না। উপরন্তু পানিতে পড়ে গেলে শরীরকে সামলানোর ক্ষমতাও ওদের নেই। তবে সন্ধ্যার সময়ও পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ঘটনা কম নয়।

বছরজুড়ে পানিতে ডুবে শিশু মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটলেও সাধারণত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরে দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়ে যায়। বর্ষার পানিতে শিশুদের জলকেলিতে মেতে ওঠাই এর অন্যতম কারণ। পানির উৎস বাড়ির যত কাছাকাছি থাকে, পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি ততই বেড়ে যায়। বিএইচআইএসের তথ্য অনুযায়ী, অধিকাংশ শিশুই বাড়ি থেকে ২০ মিটার এবং ছোট বাচ্চারা ১০ মিটার দূরত্বের কোনো পুকুর বা জলাশয়ের মধ্যে পড়ে মারা যায়। পানিতে ডোবার ঘটনা বেশি ঘটে মিঠা পানিতে, যেমন বাড়ির পাশের পুকুর-দিঘি-ডোবায়। খেলতে খেলতে কিংবা গ্রামাঞ্চলে হাত-মুখ ধুতে গিয়ে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। ডুবে যাওয়া একটি শিশুকে আরেকটি শিশু বাঁচাতে গিয়েও অনেকে দুর্ঘটনার শিকার হয়। অনেক সময় এতে উভয় শিশুই মারা যায়। আর নদীতে মারা যাওয়ার সংখ্যাও কম নয়। লোনা পানিতেও, অর্থাৎ সমুদ্রেও শিশুরা এ দুর্ঘটনার শিকার হয়।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, শহরের চেয়ে গ্রামে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার অনেক বেশি। তবে ঢাকা মহানগরেও পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ঘটনা কম নয়। ঢাকাকে ঘিরে রাখা বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, ধলেশ্বরী নদীতে অনেক শিশু ডুবে মারা যায়। পানিতে ডুবে সবচেয়ে বেশি মারা যায় বুড়িগঙ্গা-সংলগ্ন বিভিন্ন বস্তির শিশু। এ ছাড়া অধিকাংশ বস্তিই নিচু এলাকা বা ঝিলের ওপর গড়ে ওঠে। বর্ষার পানিতে এসব জায়গা পানিতে ডুবে যায়। যেসব বস্তি ঝিলের ওপর গড়ে উঠেছে, সেসব বস্তির পানিতে শিশুদের পড়ে যাওয়া নিয়মিত ব্যাপার। বেশির ভাগ শিশু টয়লেটে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনার শিকার হয়। যেহেতু ঝিলের ওপর গড়ে ওঠা বস্তির ঘরগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাঁশের তৈরি এবং তারা চলাচলও করে বাঁশের ওপর দিয়ে। বর্ষায় বাঁশে শ্যাওলা জমে পিচ্ছিল হয়ে যায়। ফলে এ সময় দুর্ঘটনা বেশি ঘটে।

বুড়িগঙ্গা-সংলগ্ন বউবাজার, রায়েরবাজার, কামরাঙ্গীর চর, মোহাম্মদপুর বস্তিতে সরেজমিনে দেখা যায়, এসব বস্তির শিশুরা সারা বছরই নদীতে গোসল করে। ওরা শুধু গোসলই করে না, এটা ওদের খেলার একটা দারুণ উৎস। ওরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাঁতার কেটে, লাফ-ঝাঁপ করে কাটিয়ে দেয়। বর্ষায় ওদের দুরন্তপনা আরও এক ধাপ বেড়ে যায়। সাঁতার না-জানা শিশুটিও তখন এই দলে ভিড়ে যায়। ফলে এখানে প্রায়ই পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এখানকার ছেলে-বুড়ো সবার বিশ্বাস, বুড়িগঙ্গায় একজন খারাপ বুড়ি আছে। তার কারণেই এসব দুর্ঘটনা ঘটে। তাদের জানানো হয়, সাঁতার না জানায় এসব শিশু মারা যায়। তখন উল্টো যুক্তি দেখিয়ে তারা বলে, তবে সাঁতার জানা শিশুরা মারা যায় কেন। অথচ স্রোতের কারণে বা অনেকক্ষণ দাপাদাপি করায় ক্লান্ত হয়ে এমন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু তারা সেসব যুক্তি মানতে নারাজ। বুড়ির অস্তিত্ব অবিশ্বাস করলে সন্তানদের ক্ষতি হবে বলে মনে করেন অনেক মা-বাবা।

শিশুস্বাস্থ্য গবেষকেরা মনে করেন, শিশুমৃত্যু কমানো না গেলে সহস্রাব্দ উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যাবে না। এতে যেমন একটি পরিবার তার সন্তান হারায়, তেমনি দেশ হারায় সম্পদ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকারি পর্যায়ে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু প্রতিরোধে এখনো কোনো কার্যক্রম পরিচালিত হয়নি। তবে এ নিয়ে কাজ শুরুর প্রক্রিয়া চলছে। তবে বেসরকারি পর্যায়ে বেশ কয়েকটি কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

এ বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিছুদিন আগে দৃষ্টিগোচর হয়, শিশুদের একটি বড় অংশ পানিতে ডুবে মারা যায়। পানিতে ডুবে যাওয়া শিশুদের নিয়ে আলাদাভাবে কাজ করা হয়নি। তবে জেলায় জেলায় আমাদের যে সচেতনতামূলক কর্মসূচি হয়, সেখানে এ বিষয়ে সতর্কতামূলক বার্তা দেওয়া হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘পরবর্তী কার্যনির্ধারণী আলোচনায় আমরা দেখব, বিষয়টি কীভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যায়।’

বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেলেও পানিতে ডুবে মারা যাওয়া শিশুর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি) টিম লিডার মো. জাহাঙ্গীর হোসাইন শিশুমৃত্যু বাড়ার জন্য বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, ভারী বর্ষণ, জলাবদ্ধতা, ঘরের কাছাকাছি খানাখন্দের পরিমাণ বৃদ্ধি ও বন্যাকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে সাঁতার শেখার বিকল্প নেই। তবে চারটি পদক্ষেপে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার কমানো সম্ভব। প্রথমত, ১০ মাস থেকে তিন বছর বয়সী শিশুদের প্রতি পরিবারের, বিশেষ করে মায়ের সার্বক্ষণিক নজরদারি এবং চার বছর বয়স থেকে শিশুকে সাঁতার শেখানো। দ্বিতীয়ত, ডোবা ও পুকুরের চারপাশে বেড়া দেওয়া। তৃতীয়ত, পানি থেকে তোলার পর পরই শিশুকে কার্যকর প্রাথমিক চিকিৎসা, অর্থাৎ শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক করতে সাহায্য করা; কারণ এ সময় শিশু অক্সিজেন-স্বল্পতায় ভোগে। চতুর্থত, শিশুকে দ্রুত হাসপাতাল বা চিকিৎসকের কাছে নেওয়ার ব্যবস্থা করা।

পানিতে ডুবে মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের চিকিৎসক তাজনীম বলেন, ফুসফুসে পানি প্রবেশ করায় অক্সিজেন-স্বল্পতাজনিত এবং পরবর্তী সময়ে মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যু ঘটে। এ ছাড়া মস্তিষ্কে অক্সিজেনের ঘাটতিতে শিশুরা দ্রুত জ্ঞান হারায়। এ জন্য দরকার যত দ্রুত সম্ভব শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাস প্রতিস্থাপন করা। অনেক সময় শীতলতার কারণেও মৃত্যু ঘটে।