‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০ কার্যকর রাখতে হবে’

পাহাড়ি জাতিসত্তার মানুষের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের স্বীকৃতি দেওয়া ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০’–এর কার্যকারিতা নিয়ে একটি মহল প্রশ্ন তোলার তৎপরতায় লিপ্ত। এই আইন পার্বত্য অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর প্রথাগত, ঐতিহ্যগত ভূমি অধিকারসহ অন্য অধিকারগুলোর সুরক্ষা দিয়েছে। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে এসব অধিকার বাস্তবায়নের দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। তাই পার্বত্য শাসনবিধি ১৯০০-এর বিরোধিতার অর্থ পার্বত্য চুক্তিরই বিরোধিতা করা।

আজ বুধবার এক বিবৃতিতে কথাগুলো বলেছেন দেশের ২৭ বিশিষ্টজন। আগামী ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৪তম বার্ষিকী। তার আগে এই বিবৃতি দিলেন বিশিষ্টজনেরা। সেখানে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০’ নামের আইনটির সুরক্ষা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তাঁরা। ১৯০০ সালের ৬ জানুয়ারি তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য এ শাসনবিধি জারি করে। পাহাড়ের মানুষদের স্বাতন্ত্র্য, তাদের ভূমির অধিকারের রক্ষাকবচ হিসেবে বিবেচিত হয় আইনটি।

বিবৃতিতে বলা হয়, ‘১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন তৎকালীন সরকার ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। এর মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯৭৫ পরবর্তী সামরিক সরকার পরিচালিত ভ্রান্ত নীতির ফলে সৃষ্ট অশান্তির অবসান ঘটে। এর ফলে পার্বত্য অঞ্চলের অবহেলিত সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর মনে আশার সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু এখন তা আমাদের আমলাতান্ত্রিক শাসনকাঠামোর একাংশের প্রক্যাশ্য ও প্রচ্ছন্ন অসহযোগিতার কারণে অনেকটা¤ম্লান হয়ে যাচ্ছে। সমগ্র দেশবাসী পার্বত্য অঞ্চলের দীর্ঘস্থায়ী শান্তি এবং উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার যে নীতি অনুসরণ করেছে এবং পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে যেসব অঙ্গীকার করেছে, তার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে এসেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ ব্যাপারে যে আন্তরিক সদিচ্ছা নানা সময় তাঁর বক্তব্য ও পদক্ষেপে প্রতিফলিত হয়েছে, তাতেও আমরা আশ্বস্ত বোধ করেছি।

বিবৃতিতে বলা হয়, বিভিন্ন সময় প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছাপ্রসূত নির্দেশনাগুলো যথাযথভাবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বাস্তবায়িত হয়নি। পার্বত্য অঞ্চলের যে মূল সমস্যা ভূমিকেন্দ্রিক জটিলতা, তা এখনো নিরসন হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা ও নির্দেশনায় বাস্তবায়িত হয়েছে, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠনও করা হয়েছে। তবে তার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ, উপযুক্ত লোকবল এবং অন্যান্য সাহায্য সহযোগিতার বিষয় এখনো আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে আছে। পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের বিধিমালার খসড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ থেকে প্রস্তাব আকারে পেশ করা হলেও এখনো তা অনুমোদনের অপেক্ষায় প্রায় দুই বছর কাল পড়ে আছে।
বিবৃতিদাতারা বলেন, ‘এরই মধ্যে আমরা এ–ও লক্ষ করছি পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০-এর কার্যকারিতা নিয়ে একটি মহল নতুন করে প্রশ্ন তোলার নানা তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে। অথচ পার্বত্য শাসনবিধি ১৯০০-এর কার্যকারিতার বিষয়টি সর্বোচ্চ আদালত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের এক গুরুত্বপূর্ণ রায়ে বেশ কয়েক বছর আগেই নিষ্পত্তি করা হয়েছে। সেই রায় অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০ দেশের সংবিধানের সঙ্গে যেমন কোনোভাবেই সাংঘর্ষিক নয়, তাই আইনটি সরকার বাতিলও করেনি। বরং এ আইনে প্রদত্ত পার্বত্য অঞ্চলের সংখ্যালঘু আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রথাগত, ঐতিহ্যগত ভূমি অধিকারসহ অন্যান্য অধিকার সুরক্ষা দিয়েছে। আর ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তিতে এই প্রথাগত, ঐতিহ্যগত অধিকার বাস্তবায়নের দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। তাই পার্বত্য শাসনবিধি ১৯০০-এর বিরোধিতার অর্থ হচ্ছে প্রকারান্তরে পার্বত্য চুক্তিরই বিরোধিতা এবং তার বাস্তবায়নকে বাধাগ্রস্ত করার নগ্ন প্রয়াস।’

‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০’ নিয়ে নতুন করে কোনো বিতর্ক যেন স্বার্থান্বেষী মহল সৃষ্টি না করতে পারে, সে জন্য ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি দাবি জানানো হয়। এ আইনের বিরোধিতার যেকোনো প্রয়াসকে বন্ধ করার লক্ষ্যে দৃঢ় ভূমিকা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয় বিবৃতিতে। সেই সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আরও বেশি গতিশীল করারও দাবি করা হয়।

বিবৃতিদাতারা বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০ বহাল রেখে তার পূর্ণ বাস্তবায়ন না হলে সরকার তথা বাংলাদেশের অর্জিত ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরের উজ্জ্বল ভবিমূর্তি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, বিশেষভাবে জাতিসংঘের সব সংস্থার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হবে। আমরা কোনোভাবেই এ ক্ষতি মেনে নিতে পারি না।’

বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, হামিদা হোসেন, সুলতানা কামাল, মিজানুর রহমান, খুশী কবির, অধ্যাপক মেঘনা গুহঠাকুরতা, ইফতেখারুজ্জামান, অধ্যাপক আবুল বারকাত, জেড আই খান পান্না, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, সারা হোসেন, শামসুল হুদা, অধ্যাপক বীণা ডি’কস্টা, রানা দাশগুপ্ত, সুব্রত চৌধুরী, নিরূপা দেওয়ান, অধ্যাপক মেজবাহ কামাল, অধ্যাপক আইনুন নাহার, অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, কাজল দেবনাথ, অধ্যাপক মংসানু চৌধুরী, তবারক হোসাইন, গৌতম দেওয়ান, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, সঞ্জীব দ্রং, অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজিমউদ্দিন খান ও জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।