পালানোর চেষ্টা পরে আত্মসমর্পণ

একাত্তরের নভেম্বর থেকে পিছু হটতে থাকে পাকিস্তানি সেনারা। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটে। আজ পড়ুন লাকসামের কাহিিন

কুমিল্লার লাকসামে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভের সামনে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল বারী মজুমদার l ছবি: এম সাদেক

কুমিল্লার লাকসাম থেকে পালাচ্ছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। পালানোর পথে ছনগা গ্রামে অবস্থান নিয়েছে এদের একটি দল। এই খবর পৌঁছে যায় মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর কাছে। ১০ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর সৈন্যদের ঘেরাও করে তারা। ১১ ডিসেম্বর
সকালে হানাদারেরা বুঝতে পারে, তারা ফাঁদে আটকা পড়ে গেছে। সেখান থেকে বের হওয়ার মরিয়া চেষ্টা চালায় তারা। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীকে লক্ষ্য করে তারা গুলি ছুড়তে থাকে।

প্রথম আলোকে সেদিনের ওই লড়াইয়ের বর্ণনা দিচ্ছিলেন লাকসাম উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার আবদুল বারী মজুমদার। বললেন, সকালে হানাদার বাহিনীর গুলিতে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনা প্রাণ হারান। একপর্যায়ে বুলেট শেষ হয়ে যায় পাকিস্তানি সেনাদের। এরপর শুরু হয় বেয়নেটের লড়াই। চলে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। একপর্যায়ে মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমপর্ণ করে কমবেশি ৫০ জন পাকিস্তানি সৈন্য। ওই লড়াইয়ে নিহত হয় অনেক পাকিস্তানি সৈন্য। হানাদারের গুলিতে মারা যায় বহু সাধারণ মানুষও।
আবদুল বারী মজুমদার বলেন, পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের পর লাকসামে শুরু হয় মুক্তিকামী জনতার উল্লাস। তবে এই আনন্দের মাঝেও তাঁদের মধ্যে ছিল সহযোদ্ধাদের হারানোর বেদনাবোধ।
এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ৯ ডিসেম্বর লাকসাম থেকে পালিয়ে যায় বেশির ভাগ পাকিস্তানি সৈন্য। কার্যত সেদিনই লাকসাম সদর মুক্ত হয়। কিন্তু পালানোর পথে লাকসামের ছনগাসহ বিভিন্ন গ্রামে কিছুসংখ্যক পাকিস্তানি সেনা অবস্থান করছিল। চাঁদপুর হয়ে নদীপথে ঢাকায় কিংবা হেঁটে ময়নামতি সেনানিবাসে যাওয়ার জন্য গ্রামগুলোতে অবস্থান নিয়েছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা।

লাকসাম উপজেলার কৈতরা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবদুল আউয়াল বলেন, ‘ছনগায় আত্মসমর্পণের ঘটনার দিন রাতে লাকসামের মুদাফফরগঞ্জ এলাকা দিয়ে কিছু পাকিস্তানি সেনা গুলি করতে করতে কুমিল্লা সেনানিবাসের দিকে যাচ্ছিল। ওই রাতে মুদাফফরগঞ্জ মুচিপুলের সামনে মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় অনেক পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। ছয় পাকিস্তানি সৈন্যের লাশ আমি রাস্তা থেকে সরিয়েছি।’
সি এম তারেক রেজার ‘একাত্তর বিজয়ের সেই ক্ষণ’ বইয়ের বর্ণনা অনুযায়ী লাকসাম ও চৌদ্দগ্রামসহ বিভিন্ন স্থান থেকে পিছু হটে আসা পাকিস্তানি সৈন্যরা ময়নামতি সেনানিবাসে অবস্থান নেয়। সব মিলিয়ে ময়নামতিতে পাকিস্তানি সৈন্যের সংখ্যা দাঁড়ায় চার হাজারে। ৯ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় মিত্রবাহিনী দুই দিক থেকে সেনানিবাস অবরোধ করে। ১০ ডিসেম্বর উত্তর, পশ্চিম এবং দক্ষিণ দিক থেকে অবরুদ্ধ পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর বিমান ও গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় প্রচণ্ড হামলা চালায় মিত্রবাহিনী। কিন্তু পাকিস্তানিদের কঠিন প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করা সম্ভব হয়নি। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী যখন ঢাকায় আত্মসমপর্ণ করে, তখন ময়নামতি সেনানিবাসে ৮৯ জন অফিসার, ১৭৫ জন জেসিও এবং বিভিন্ন র্যা ঙ্কের চার হাজার সৈন্য মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমপর্ণ করে।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী লাকসামের বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে। লাকসামের রেলওয়ে জংশন, হাসনাবাদ, মুদাফফরগঞ্জ, ছনগা, চুনাতি, নোয়াপাড়া ও মনোহরপুর গ্রামে হানাদার বাহিনী হত্যাকাণ্ড ও তাণ্ডব চালিয়েছিল।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন কুমিল্লার নিজস্ব প্রতিবেদক গাজীউল হক ]