পি কে হালদারের ৩৬ মামলার একটিতে অভিযোগপত্র

অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের (সাবেক এনআরবি গ্লোবাল) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদারের বিরুদ্ধে ৩৬টি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এসব মামলার মধ্যে মাত্র একটিতে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছে।

বাকি ৩৫ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন কবে নাগাদ জমা হবে, সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য জানাতে পারেননি দুদকের তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এসব মামলায় মোট ৮৩ জনকে আসামি করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ১১ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

৩৬ মামলায় পি কে হালদার ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে।

তদন্তপ্রক্রিয়ায় যুক্ত দুদকের এক পদস্থ কর্মকর্তা গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, পি কে হালদার আত্মীয়স্বজনকে দিয়ে ৪০টি কাগুজে প্রতিষ্ঠান বানিয়ে ঋণের নামে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস লিমিটেড (আইএলএফএসএল), পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড (পিএলএফএসএল), এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানিসহ (বিআইএফসি) অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বের করে নেন।

‘অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের মামলায় পি কে হালদার, তাঁর মা, ভাই, নিকটাত্মীয়সহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। অর্থ পাচার আইনে তিনি ও তাঁর ৮৩ সহযোগীর বিরুদ্ধে আরও ৩৫টি মামলা করা হয়েছে। পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
গুলশান আনোয়ার প্রধান, তদন্ত তদারক কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক

তদন্ত তদারক কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের মামলায় পি কে হালদার, তাঁর মা, ভাই, নিকটাত্মীয়সহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। অর্থ পাচার আইনে তিনি ও তাঁর ৮৩ সহযোগীর বিরুদ্ধে আরও ৩৫টি মামলা করা হয়েছে। পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তিনটি মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে। আশা করছি, ছয় মাসের মধ্যে সব মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়া হবে। তাঁর বিরুদ্ধে আরও কয়েকটি মামলা করার প্রস্তুতি চলছে।’

দুদকের পিপি মীর আহমেদ আলী সালাম প্রথম আলোকে বলেন, পি কে হালদারের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের একটি মামলায় দেওয়া অভিযোগপত্র আমলে নিয়েছেন ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত। ২৫ মে এই মামলার শুনানির দিন ধার্য রয়েছে।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা থেকে পি কে হালদারসহ পাঁচজনকে গত শনিবার গ্রেপ্তার করে দেশটির কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)।

এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুদক সূত্র জানিয়েছিল, দেশের চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইএলএফএসএল, পিএলএফএসএল, বিআইএফসি ও এফএএস ফাইন্যান্স থেকে পি কে হালদার নামে-বেনামে বিভিন্ন কোম্পানির নামে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা বের করে নেন। টাকা বের করার আগে শেয়ার কিনে তিনি এসব প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেন। ২০২০ সালের শুরুতে তাঁর এই আর্থিক কেলেঙ্কারি জানাজানি হয়। তবে এর আগেই ২০১৯ সালের শেষ দিকে তিনি দেশ ছাড়েন। ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি পি কে হালদারের বিরুদ্ধে প্রায় ২৭৫ কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগে মামলা করে দুদক।

পি কে হালদারকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। অর্থ পাচার মামলায় অর্থের পূর্ণাঙ্গ গতিপথ বের করেই আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে দুদক।
খুরশীদ আলম খান, দুদকের প্রধান আইনজীবী

পি কে হালদার ও তাঁর সহযোগীদের সম্পদ কত

দুদকের অভিযোগপত্রের তথ্য বলছে, গত ১০ বছরে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নামে-বেনামে ৯৩৩ কোটি টাকার জমি, ফ্ল্যাট ও হোটেল কেনেন পি কে হালদার। এর মধ্যে জমি কিনেছেন ৬ হাজার ৭৯০ শতাংশ। এই সম্পদের বাজারমূল্য প্রায় ৩৯১ কোটি ৭৫ লাখ ৮১ হাজার ১২ টাকা। নিজের নামে তিনি জমি কিনেছেন ৪ হাজার ১৭৪ শতাংশ। দলিলে এসব জমির দাম ৬৭ কোটি ৯৪ লাখ ২০ হাজার ৯৩০ টাকা দেখানো হলেও প্রকৃত বাজারমূল্য প্রায় ২২৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া ধানমন্ডিতে তাঁর নামে দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে।

অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, পি কে হালদার তাঁর নিকটাত্মীয় পূর্ণিমা রানী হালদারের নামে উত্তরায় একটি ভবন নির্মাণ করেন, যার দাম প্রায় ১২ কোটি টাকা। পূর্ণিমার ভাই উত্তম কুমার মিস্ত্রির নামে তেজগাঁও, তেজতুরী বাজার ও গ্রিন রোডে ১০৯ শতাংশ জমি কেনেন, যার বাজারমূল্য ২০০ কোটি টাকা। পি কে হালদার কাগুজে কোম্পানি ক্লিউইস্টোন ফুডসের নামে কক্সবাজারে দুই একর জমির ওপর র‌্যাডিসন নামে আটতলা হোটেল নির্মাণ করেন, যার বাজারমূল্য প্রায় ২৪০ কোটি টাকা। তাঁর খালাতো ভাই অমিতাভ অধিকারী ও অনঙ্গ মোহন রায়ের নামে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ৪০৪ শতাংশ জমি কেনেন, যার দাম প্রায় ১৬৭ কোটি টাকা।

তবে পি কে হালদারকে গ্রেপ্তারের পর ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ইডি বলছে, কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় বিপুল সম্পদ কিনেছেন তিনি। কলকাতার বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় তিনি ও তাঁর সহযোগীদের বেশ কয়েকটি বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক মো. সালাহউদ্দিন গতকাল বলেন, পি কে হালদার ও তাঁর সহযোগীদের কানাডায় অর্থ পাচারের তথ্য জানা গেলেও ভারতে এত সম্পদ পাচারের তথ্য এত দিন কারও জানা ছিল না। এখন কলকাতায় তাঁর অবৈধ সম্পদের খবর বেরোচ্ছে। তাই আদালতের অনুমতি নিয়ে তিনিসহ অন্যদের ভারতসহ অন্যান্য দেশে থাকা অবৈধ সম্পদের তথ্য সংগ্রহ করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।

দুদকের প্রধান আইনজীবী খুরশীদ আলম খান প্রথম আলোকে বলেন, পি কে হালদারকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। অর্থ পাচার মামলায় অর্থের পূর্ণাঙ্গ গতিপথ বের করেই আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে দুদক।