পিআইএর বাঙালি বৈমানিকদের হত্যা

শুরু হলো স্বাধীনতার মাস মার্চ। ১৯৭১ সালে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ জন্ম দিয়েছে অজস্র মর্মস্পর্শী মানবিক গল্পের। সেগুলো ছড়িয়ে আছে নানান দলিলে, অনেকের ভাষ্যে।

তেজগাঁও বিমানবন্দরে বোমার আঘাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত পিআইএর একটি উড়োজাহাজ, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের। ছবি: সংগৃহীত

বাঙালি নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী একবার বলেছিলেন, পিআইএ (পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস) এবং তিনিই দুই পাকিস্তানের মধ্যে একমাত্র যোগসূত্র। আর দুটো যোগসূত্রই পাকিস্তানিরা কেটে দিয়েছিল। ১৯৬৩ সালে সোহরাওয়ার্দী বৈরুতে রহস্যজনকভাবে মারা যান। অনেকের অভিযোগ, তাঁর মৃত্যুর পেছনে পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র ছিল।

১৯৭১ সালে পিআইএর বাঙালি বৈমানিক ছিলেন ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাকিস্তানের এই রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থায় বাঙালি বৈমানিকের সংখ্যা ছিল খুবই কম। যে কজন ছিলেন, তাঁদেরও পাকিস্তান সরকার কঠোর নজরদারিতে রাখত। পাকিস্তান এয়ারলাইনস পাইলট অ্যাসোসিয়েশন (পিএএলপিএ) নামে বৈমানিকদের যে সংগঠনটি ছিল, তারও নেতৃত্বে ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানিরা। বাঙালি বৈমানিকদের ন্যায্য দাবি পেশ করলেও তা আমলে নেওয়া হতো না। বাধ্য হয়ে বাঙালি বৈমানিকেরা পৃথক সংগঠন করেন।

মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীর প্রতীক এই সাহসী বৈমানিকদের কাহিনি তুলে ধরেছেন মেজর জেনারেল আয়ান কারডোজোসম্পাদিত ইন কোয়েস্ট অব ফ্রিডম: দ্য ওয়ার অব ১৯৭১ বইতে।

কাজী সাজ্জাদের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতে পিআইএর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাকুর উল্লাহ দুররানি ঢাকায় এলে সমিতির কয়েকজন তাঁর সঙ্গে দেখা করেন এবং নিজেদের সমস্যার কথা বলেন। তিনি তাঁদের দাবিদাওয়া লিখিতভাবে দিতে বললে বৈমানিকেরা দ্রুত সেটি দিয়ে দেন।’

সাজ্জাদ আলী জহির আরও লিখেছেন, ‘দুররানি কোনো প্রতিকার না করে বাঙালি বৈমানিকদের তৎপরতার কথা পাকিস্তান সেনা কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেন।…পরবর্তীকালে সেনাবাহিনী এই লিখিত দলিলকে বাঙালি বৈমানিকদের বিরুদ্ধে কাজে লাগায়।’

পূর্ব পাকিস্তান এয়ারলাইনস বৈমানিক সমিতির (ইপিএএলপিএ) সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন যথাক্রমে ডব্লিউ আর চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন আলমগীর। আওলাদ হোসেন মার্কেটে সমিতির অফিস নেওয়া হয়েছিল। ওই বইয়ের ভাষ্য অনুযায়ী, সমিতির প্রথম কয়েকটি বৈঠক হয় ক্যাপ্টেন আলমগীরের মোহাম্মদপুরের বাসায়। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের কাছে খবর পৌঁছে যায় এবং তারা বাড়িটি নজরদারিতে রাখে।

সমিতির সহসভাপতি ক্যাপ্টেন আবদুল খালেক ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে করাচি থেকে ঢাকায় ফিরে জানান, বিপুলসংখ্যক পাকিস্তানি সেনা সাদাপোশাকে ঢাকায় এসেছেন। এ ছাড়া লাহোর ও রাওয়ালপিন্ডি থেকেও পিআইএর বিশেষ বিমানে সেনাদের আনা হয়েছে। ১ মার্চ ক্যাপ্টেন শাহাব ও আলমগীর সাত্তার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে তাঁকে পাকিস্তানি সেনাদের আনার বিষয়টি জানান।

মুক্তিযুদ্ধের ডেপুটি চিফ অব স্টাফ এয়ার মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকার সে সময়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে লিখেছেন, ‘ইতিমধ্যে তারা গোপনে পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য আনা শুরু করে। ...সম্ভবত ১৮ ফেব্রুয়ারি বেলা সাড়ে তিনটার দিকে বিমানবন্দরে একটি এয়ারক্রাফট অবতরণ করে। বিমানটি নামার পর দেখলাম সিভিলিয়ান পোশাকে সেনাবাহিনীর জওয়ানরা নামছে।’ (১৯৭১: ভেতরে বাইরে, প্রথমা ২০১৪)

১ মার্চ পাকিস্তান সরকার ফরমান জারি করে, কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া পিআইএর বাঙালি বৈমানিক ও কর্মীরা বিমানবন্দরে যেতে পারবেন না। তখন বিমানবন্দরের সব কাজ পশ্চিম পাকিস্তানি বৈমানিক ও অবাঙালি কর্মীদের দিয়ে করানো হয়। বাঙালি বৈমানিকদের পিআইএর বিমান চালানো থেকেও বিরত রাখা হয়।

ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার জানান, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর অন্যান্য পেশাজীবীর মতো বাঙালি বৈমানিকেরাও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন: যেকোনো মূল্যে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে হবে। ২৩ মার্চ তাঁরা বঙ্গবন্ধুর কাছে নতুন বিমান পরিচালনার জন্য ৪৪ পৃষ্ঠার একটি পরিকল্পনা জমা দেন। একই সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেন, পরিত্যক্ত কয়েকটি এফ-২৭ বিমান চালিয়ে তাঁরা অন্য কোথাও নিয়ে যাবেন, যাতে সেগুলো ভবিষ্যতে প্রতিরোধযুদ্ধে ব্যবহার করা যায়।

২৫ মার্চ রাতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী অন্যদের সঙ্গে বাঙালি বৈমানিকদের বাড়িঘরও তল্লাশি করে। তারা প্রথমে ক্যাপ্টেন সিকান্দরকে খুঁজে বের করে ও হত্যা করে। পরে সেনাবাহিনী শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে ক্যাপ্টেন আমিরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন আলমগীর, ক্যাপ্টেন এন এস হায়দার ও পিআইএর উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হককে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। আর তাঁদের হদিস পাওয়া যায়নি।

প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে গতকাল সাজ্জাদ আলী জহির জানান, তিনি পিআইএর পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পেরেছেন, পাকিস্তানি সেনারা সেদিন বাসা থেকে যেসব বৈমানিককে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তাঁদের কয়েকজনকে পুরোনো বিমানবন্দরের কাছে একটি বাড়িতে রাখা হয় এবং ২৭ অথবা ২৮ মার্চ তাঁদের হত্যা করা হয়। এর বাইরেও পিআইএর ৩৩ জন বাঙালি কর্মচারীকে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা।

বাঙালি বৈমানিকদের মধ্যে সাহাবুদ্দীন আহমেদ, আকরাম আহমেদ, শরফুদ্দিন, ক্যাপ্টেন খালেক, মুকিত ও আলমগীর সাত্তার মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তাঁদের প্রথম তিনজন বীর উত্তম ও শেষের তিনজন বীর প্রতীক খেতাব পান।

পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে পিআইএর যে কজন বাঙালি বৈমানিককে হত্যা করে, তাঁরা সবাই ছিলেন প্রশিক্ষক বৈমানিক, পিআইএর সেরা বৈমানিক।