পিনাক-৬ লঞ্চডুবি: তিন বছরেও অভিযোগপত্র জমা হয়নি

২০১৪ সালের ৪ আগস্ট কাঁঠালবাড়ি-শিমুলিয়া নৌরুটে পদ্মায় ডুবে যায় পিনাক-৬ নামের লঞ্চটি। স্বজনদের হারিয়ে এক নারীর আহাজারি। প্রথম আলো ফাইল ছবি
২০১৪ সালের ৪ আগস্ট কাঁঠালবাড়ি-শিমুলিয়া নৌরুটে পদ্মায় ডুবে যায় পিনাক-৬ নামের লঞ্চটি। স্বজনদের হারিয়ে এক নারীর আহাজারি। প্রথম আলো ফাইল ছবি

কাঁঠালবাড়ি-শিমুলিয়া নৌরুটে পিনাক-৬ লঞ্চ দুর্ঘটনার তিন বছরেও অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি। এরই মধ্যে মামলায় সাতজন তদন্তকারী কর্মকর্তা রদবদল হয়েছেন। এই অবস্থায় ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন নিহত ব্যক্তিদের স্বজন ও এলাকাবাসী।

২০১৪ সালের ৪ আগস্ট ঈদের ছুটি শেষে কাঁঠালবাড়ি-শিমুলিয়া নৌরুট হয়ে রাজধানী ঢাকায় ফিরছিল দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ। পিনাক-৬ নামের লঞ্চটি ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী বহনের কারণে পদ্মায় ডুবে যায়। এই লঞ্চ দুর্ঘটনায় বরিশাল, ভোলা, শরীয়তপুরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয় ৪৯টি মরদেহ। এ ছাড়া ওই সময় নিখোঁজ ৬৪ যাত্রীর সন্ধান মেলেনি আজও। যাদের বেশির ভাগই মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার বাসিন্দা। অজ্ঞাত পরিচয়ে দাফন হওয়া ২২ জনের মরদেহের ডিএনএ পরীক্ষা সম্পন্ন হলেও, এখন পর্যন্ত তাদের পরিচয় শনাক্ত হয়নি।

মামলার বর্তমান তদন্তকারী কর্মকর্তা মুন্সিগঞ্জের লৌহজং থানার উপপরিদর্শক শফিকুল ইসলাম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার আগে ছয়জন কর্মকর্তা এই মামলার তদন্ত করেছেন। আমি সপ্তম তদন্ত কর্মকর্তা। দুই মাস হলো আমি এ মামলার দায়িত্ব পেয়েছি। মামলার ছয়জন আসামির মধ্যে লঞ্চটির মালিক আবু বকর ওরফে কালু মিয়া ও তাঁর ছেলে ওমর ফারুককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকি আসামিরা পলাতক রয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’ মামলার তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কবে নাগাদ আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হবে, তা এখনো নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না।

মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইমরান আহম্মেদ বলেন, ‘পিনাক-৬ লঞ্চ দুর্ঘটনার পর থেকে কোনো লঞ্চে আর মাত্রাতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে চলতে দেওয়া হচ্ছে না। এ ঘটনায় মুন্সিগঞ্জের লৌহজং থানায় মামলা হয়েছে। আমাদের কাছে মামলা-সংক্রান্ত কোনো তথ্য চাওয়া হলে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। আর যদি কেউ অজ্ঞাত হিসেবে দাফন হওয়া কারও সন্ধান চায়, তাহলে ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফল দেখে নিশ্চিত করা হবে।’

ওই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে প্রাণে বেঁচে যান শিবচর উপজেলার উত্তর বাখরেরকান্দি এলাকার ভ্যানচালক তারা মিয়া। তিনি বেঁচে গেলেও লঞ্চডুবির তিন দিন পর তাঁর ছেলে নুরে আলমের মরদেহ ভোলার চরফ্যাশন থেকে উদ্ধার হয়। কিন্তু ওই ঘটনায় নিখোঁজ তাঁর মেয়ে শাহিনুর আক্তারের খোঁজ মেলেনি আজও। বৃহস্পতিবার তাঁর বাড়িতে কথা হয় তারা মিয়ার স্ত্রী গলেনুর বেগমের সঙ্গে। এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন সন্তান হারানো এই মা। তিনি বলেন, ‘মাইয়াডার লাশটা আজও খুঁইজা পাইলাম না। জানি না মাইয়াডা বাইচ্চা আছে নাকি মইরা গেছে। পোলা আমার সংসার চালাত। আজ বাজানও নাই, আর সংসারও চলে না। থাকলে ওর আব্বারে ভ্যান চালাইতে দিত না।’
নিহত নুরে আলমের খালা পাখি বেগম বলেন, ‘ছেলেটা যে কাজ করত তা দিয়ে এই পরিবার চলত। এখন ছেলেটা নাই, নুরের বাবা বৃদ্ধ বয়সে কাজ করে পরিবার চালাচ্ছে। সরকার যদি এই অসহায় পরিবারকে সহযোগিতা করত, তাহলে এই পরিবারটি বাঁচতে পারত।’

পিনাক-৬ লঞ্চ দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী শিবচরের উৎরাইল এলাকার বাসিন্দা ও শিক্ষক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, পিনাক-৬ বাইরে থেকে রংচঙে ভাব থাকলেও ভেতরটা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। সেদিন আকাশ ছিল মেঘে ঢাকা। পদ্মায় ছিল প্রমত্ত ঢেউ। ঘাট থেকে লঞ্চটি যখন মূল পদ্মায় গিয়ে পৌঁছায়, তখন দেখা যায় অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে লঞ্চটি দুলছে। তীব্র স্রোত আর ঢেউয়ের তোড়ে দ্বিগুণেরও বেশি যাত্রী নিয়ে ডুবে যায় লঞ্চটি।