পুকুর পুনঃখননের কোটি টাকার প্রকল্প প্রশ্নবিদ্ধ

প্রকল্পের কাজ শেষ না হতেই মাছ চাষ, অযত্ন, অবহেলা ও তদারকির অভাবে দূষিত হয়ে পড়ছে পুকুরের পানি। কল্যাণপুর, শ্রীপুর, মাগুরা। ছবি: প্রথম আলো
প্রকল্পের কাজ শেষ না হতেই মাছ চাষ, অযত্ন, অবহেলা ও তদারকির অভাবে দূষিত হয়ে পড়ছে পুকুরের পানি। কল্যাণপুর, শ্রীপুর, মাগুরা। ছবি: প্রথম আলো

মাগুরায় গ্রীষ্মকালে সুপেয় পানির সংকট দূর করতে সাতটি পুকুর পুনঃখননের প্রকল্প নিয়েছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (ডিপিএইচই)। আর এ জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে সোয়া দুই কোটি টাকা। ইতিমধ্যে প্রতিটি পুকুরে গড়ে ৭০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ঠিকাদারও বিল পেয়েছেন চুক্তিমূল্যের প্রায় অর্ধেক।

তবে প্রকল্পের কাজ শেষ না হতেই খনন করা এলাকায় মাছ চাষ, অযত্ন-অবহেলা ও তদারকির অভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে পুকুরের পানি। এ পরিস্থিতিতে কাজ শেষের আগেই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ও কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর অবশ্য বলছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে এমন মনে হলেও ভবিষ্যতে এটি কাজে লাগবে।

স্থানীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, যেসব এলাকার পানিতে লবণাক্ততা আছে, সেসব এলাকার মানুষকে সুপেয় পানি সরবরাহ করাই এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। পাশাপাশি
রয়েছে পুকুরের গভীরে পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে বিশেষত চৈত্র-বৈশাখ মৌসুমে পানির স্তর ঠিক রাখা এবং ভূগর্ভস্থ পানির চাপ কমাতে উপরিভাগের পানি ব্যবহারে এলাকার মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা।

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, পুকুরগুলো জেলা পরিষদের। পাইলট প্রকল্প হিসেবে ২ কোটি ২৫ লাখ ১৩ হাজার টাকা ব্যয়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই  প্রকল্পের কাজ শুরু হয়, যা চলতি বছরের জুনে শেষ হওয়ার কথা। প্রকল্পের আওতায় সাতটি পুকুর মূলত পুনঃখনন করা হচ্ছে। অর্থাৎ গ্রীষ্মকালে সুপেয় পানির সংকট মোকাবিলায় সুপেয় পানির যে জলাধারগুলো তৈরি হচ্ছে, সেগুলোতে আগে থেকেই পুকুর ছিল।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক ঠিকাদার বলেন, খননের খরচ নির্ভর করে খনন করা মাটির ওপর। জেলা পরিষদের পুকুরগুলোর ক্ষেত্রে পুনঃখনন ও পরবর্তী কাজ সম্পন্ন করতে সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা খরচ হতে পারে।

প্রকল্পের আওতায় রয়েছে মাগুরা সদর উপজেলার বনগ্রাম, জাগলা, শিবরামপুর, রায়গ্রাম এবং শ্রীপুর উপজেলার খামারপাড়া, কল্যাণপুর ও রাজাপুর পুকুর। প্রতিটি পুকুরের পানির গভীরতা হবে ৫ থেকে ৭ দশমিক ৫ মিটার। চারপাশে কাঁটাতারের বেড়ার পাশাপাশি পুকুরের অপব্যবহার রোধে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত করতে থাকবে একটি ফটক। চারপাশে থাকবে পায়ে হাঁটা ইটের রাস্তা। থাকবে পুকুরপাড় রক্ষার জন্য বেষ্টনী। পুকুরের আকার সর্বনিম্ন দেড় হাজার বর্গমিটার থেকে সর্বোচ্চ ৫ হাজার বর্গমিটার। পুকুরগুলোকার্যত জেলা পরিষদের হওয়ায় গোটা কার্যক্রম দেখভাল করার জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকার জেলা পরিষদের সদস্যের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি তদারকি কমিটি করা হয়েছে। প্রকল্পের এসব পুকুরে পানি সুপেয় রাখতে মাছ চাষ কিংবা অন্যান্য গৃহস্থালি কাজ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ বলা আছে।

সরেজমিনে এক দিন

১৩ ফেব্রুয়ারি সরেজমিনে দেখা যায়, বিভিন্ন পুকুরে মাছ চাষ, গোসলসহ অন্যান্য ব্যবহারিক কাজ সারতে শুরু করে দিয়েছেন অনেকে। সদর উপজেলার শিবরামপুরে পুকুর খনন সম্প্রতি শেষ হয়েছে।এই পুকুরেপলাশ হোসেন মাছের পোনা অবমুক্ত করেছেন। জাকির হোসেননামের স্থানীয় আরেক ব্যক্তিগত বর্ষা মৌসুমে তাঁর পেয়ারা খেতের জলাবদ্ধতা নিরসনে এই পুকুরের সঙ্গে পাইপ সংযুক্ত করে খেতের নোংরা পানি এই পুকুরে ফেলেছেন। মাছ চাষ, গোসলসহ অন্যান্য ব্যবহারিক কাজ সম্পাদনের একই রকম চিত্র দেখা যায় শ্রীপুরের রাজাপুর, কল্যাণপুর ও খামারপাড়া পুকুরেও।

শ্রীপুরে রাজাপুরের পুকুরে মাছ চাষ করছেন মোজাহার আলী।একই উপজেলার কল্যাণপুর পুকুরে মাছ চাষ করছেন সাহেব আলী।এ বিষয়ে তদারকি কমিটিতে থাকা জেলা পরিষদ সদস্য আরজান বাদশা বলেন, ‘আমি পুকুর তদারক কমিটিতে আছি শুনেছি। কিন্তু এখনো কোনো কাজে কেউ ডাকেননি।’

রফিকুল ইসলাম নামের রাজাপুরের এক বাসিন্দা বলেন, ‘পুকুরগুলো পরিত্যক্ত নয়। আগে থেকেই পানি ছিল। তারপরওসংস্কারে এত টাকা ব্যয়ের বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন জাগে। আমরা কোনো দিনই পুকুরের পানি পান করি না। নলকূপ ছাড়া খাওয়ার পানি অন্য কোথাও থেকে কেউ নেন না।’

কাজের অগ্রগতি প্রতিবেদন

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কাজেরঅগ্রগতি প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি পুকুরে গড়ে ৭০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আর ঠিকাদার বিল পেয়েছেন চুক্তিমূল্যের প্রায় অর্ধেক। প্রকল্পের মূল ঠিকাদার চুয়াডাঙ্গার জীবননগরের মেসার্স জাকাউল্লাহ অ্যান্ড ব্রাদার্স। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই ঠিকাদারের লাইসেন্স ব্যবহার করে কাজ করছেন স্থানীয় কয়েকজন ঠিকাদার। এ বিষয়ে ঠিকাদারদের একজন আসিফ আল আসাদ বলেন, ‘খননকাজ দরপত্র অনুযায়ী করা হচ্ছে। সিংহভাগ কাজ শেষ। বাকিটা জুনের মধ্যে শেষ হবে। তিনি দাবি করেন, কাজে কোনো অনিয়ম হয়নি।

জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পঙ্কজ কুমার কুণ্ডু বলেন, গভীরতা যদি সঠিক থাকে, সেটি সুপেয় পানির ক্ষেত্রে না হোক, পানি সংরক্ষণে ভূমিকা রাখবে। এর উপকারিতা এলাকাবাসী পাবেন। ভবিষ্যতে এ ধরনের পুকুর খনন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ের পানির স্তরের সার্বিক অবস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরের যথাযথ সমন্বয় সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

মাগুরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফারুক আহম্মেদ প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটি প্রয়োজনীয় মনে না হলেও ভবিষ্যতে পানির স্তর আরও নিচে নেমে গেলে এটি কাজে আসবে। পুকুরে মাছ চাষসহ অন্যান্য অভিযোগের বিষয়ে এই প্রকৌশলী বলেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রকল্পের ব্যয়ে অনিয়মের বিষয়ে তিনি দাবি করেন, নকশা অনুযায়ী সব কাজ শেষ করা হবে। এখানে ঠিকমতো কাজ শেষ না করে ঠিকাদারের বিল পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।