পুরো গ্রাম এখনো ডুবে আছে

সিলেটে বন্যাফাইল ছবি : প্রথম আলো

বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে ক্ষয়ক্ষতির চিত্রও। রাস্তায় উপড়ে পড়ে আছে গাছ। উল্টে আছে ট্রাক। বিকল পড়ে আছে অসংখ্য বাস আর সিএনজিচালিত অটোরিকশা।

পানিতে ভাসছে গরু, ছাগল, বিড়াল, ইঁদুরের মরদেহ। তাতে ঠোকরাচ্ছে কিছু কাক, শকুন। হেলে মাটির সঙ্গে মিশে আছে খেতের পচা সবজি। বিধ্বস্ত হয়েছে বাঁশ-মাটির ঘর, দুমড়েমুচড়ে আছে টিনের বেড়া। দেবে গেছে রাস্তা। গত কদিনের বন্যার পানি যেন লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেছে গোটা জনপদ।

এই চিত্র সিলেটের বিশ্বনাথ ও ছাতক উপজেলার। বিশ্বনাথের একটি গ্রাম এখনো পুরোটাই পানিতে তলিয়ে আছে। গতকাল সোমবার সাত ঘণ্টা ঘুরে বিধ্বস্ত জনপদের এমন দৃশ্য দেখা গেল। সকাল সাড়ে ১০টায় সিলেট নগরের মদিনা মার্কেট এলাকা থেকে এ প্রতিবেদকের যাত্রা শুরু হয়। জেলার বিশ্বনাথ উপজেলার কিছু এলাকা ঘুরে বিকেলে এ যাত্রা শেষ হয় সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলায়। এ সময় অসংখ্য ক্ষুধার্ত মানুষের করুণ চাহনি চোখে পড়ল।

চলতি পথে এমন অনেকের সঙ্গে কথাও হলো। তাঁরা জানালেন, ঘরে চাল–ডাল, তেল–নুন যা ছিল সবই পানিতে ভেসে গেছে। জিনিসপত্র কেনার মতো হাতে টাকাপয়সাও নেই। দুমুঠো খাবারের সন্ধানে এখন এদিক-ওদিক ছুটছেন তাঁরা। তাঁদেরই একজন সত্তরোর্ধ্ব রেণু মালা।

রেণু মালার বাড়ি ছাতকের ছৈলা আফজলাবাদ ইউনিয়নের শিবনগর গ্রামে। গ্রামের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রেললাইন-সংলগ্ন এলাকায় তাঁর ঘর। আগের রাতেও গলাসমান পানি ছিল, এখন কোমরসমান। গেল বুধবার রাতে উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানি প্রবল বেগে ঘরে ঢুকতে শুরু করে।

আতঙ্কিত হয়ে গভীর রাতেই একমাত্র মেয়ে ও দুই নাতিকে নিয়ে বাড়ি ছাড়েন। আশ্রয় নেন পাশের রেলস্টেশনের একটি ছাপরাঘরে। পরের দিন সকালে ফিরে দেখেন কাপড়চোপড় থেকে শুরু করে ঘরের সব ভেসে গেছে। পানিতে আটকা পড়ে তাঁর তিনটা ছাগল ও ছয়টা হাঁস মারা গেছে।

কাঁদতে কাঁদতে রেণু মালা বলেন, তাঁর স্বামী মারা গেছেন অনেক বছর আগে। মেয়ে আরফিনা বেগম বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। দুই নাতির ছোটটি যখন মেয়ের গর্ভে, তখন আরফিনার স্বামীও মারা যান। এরপর মেয়ে ও নাতিদের তিনিই দেখভাল করেন। বৃদ্ধ বয়সে পরের বাড়িতে কাজ করেন। আর নিজের পালা হাঁসের ডিম বেচে সংসার চালান। বানের পানিতে ভেসে যাওয়া ছাগল আর হাঁসগুলোই ছিল তাঁর আয়ের মূল উৎস।

রেণু মালা বলেন, ‘বানের পানি আমারে চুবাইয়া গেছে। পরের বাড়িত কাম কইরা আর ডিম বেইচা সবার জান রক্ষা করতাম। সব হারাইয়া বেঅস্ত্র (অবলম্বনহীন) অইয়া গেছি আমি। খাওন নাই। চিন্তায় বাঁচি না। জনে জনে হাত পাতি, কেউ কুনতা দেয় না।’

আরও পড়ুন

বেলা আড়াইটার দিকে সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার খোজারপাড়া গ্রামে নৌকায় গিয়ে দেখা গেল, পুরো গ্রাম ডুবে আছে। প্রতিটি ঘরেই হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি। বিদ্যুৎ নেই। অনেক কাঁচা বাড়ি ধসে গেছে। যে রাস্তা ধরে নৌকা গেছে, সেটা ছিল গ্রামবাসীর হাঁটাচলার পথ। এখন সেখানে বুকপানি। পানিতে ভাসছে মরা গরু আর ছাগল। পাশাপাশি থেকেও পানির কারণে একেকটা ঘর আরেকটা ঘরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে।

খোজারপাড়া গ্রামের হাজেরা বেগম (৩৯) জানান, ৩ জুন তাঁর স্বামী নুরুল ইসলাম (৪২) মারা যান। এর মধ্যে গত বুধবার থেকে ঘরে উঠেছে কোমরপানি। স্বামীর মৃত্যুর শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই বানের পানি তাঁর জীবন আরও সংকটময় করে তুলেছে।

হাজেরা বলেন, ‘আমি গৃহিণী। কোনো আয় নেই। স্বামী মারা যাওয়ায় সংকটে পড়লাম। এখন বানের পানি আরও সমস্যায় ফেলল। সন্তানদের নিয়ে কীভাবে আগামী দিন যাবে, ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছি না।’

শুধু হাজেরা বেগম নন, বন্যার পানিতে সব হারিয়ে অনেকেই এখন অকূল পাথারে পড়েছেন। একমুঠো খাবারের সন্ধানে তাঁরা এখন হাপিত্যেশ করছেন। এ রকমই একজন মছব্বির আলী (৪০)। সিলেট সদর উপজেলার কসকালিকা বলাউড়া গ্রামে তাঁর বাড়ি। পেশায় কৃষক।

বানের পানিতে তাঁর ধানের গোলা ভেসে গেছে। গোলায় থাকা ধানে অঙ্কুর গজিয়ে গেছে এই কদিনে। সব হারিয়ে দিশেহারা মছব্বির আয়ের জন্য মাছ মারতে নেমেছেন বানের পানিতে। বাড়ির পাশে জাঙ্গাইল গ্রামের ধারে সিলেট-সুনামগঞ্জ রোডে দাঁড়িয়ে ছিটকা জাল দিয়ে মাছ ধরছিলেন।

মছব্বির যেখানে মাছ ধরছিলেন, এর পাশেই বড়সড় একটি মালবাহী ট্রাক উল্টে আছে। আগের দিন রাতে এটি উল্টে গেছে জানিয়ে মছব্বির বলেন, ‘বানের পানিতে চুলা ডুবি গেছে। টানা কয়েক দিন ভাত না খাইয়া ছিলাম। গতকাইল ডাইল আর আলু দিয়া খাইছি। বাইচ্চা কইছে, মাছ খাইত। তাই মাছ মারতে আইলাম।’