পুলিশ ও প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংশয়

>

• সর্বশেষ পাঁচ সিটি নির্বাচনে পুলিশের ওপর ইসির নিয়ন্ত্রণ ছিল না
• অনেক ক্ষেত্রে ইসির চেয়ে পুলিশকেই বড় ভূমিকায় দেখা যায়
• বিএনপিসহ ১২ দল গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলো ইসির অধীনে রাখার পক্ষে
• এই সুপারিশকে সংবিধানের সঙ্গে সম্পর্কিত হিসেবে চিহ্নিত করে ইসি
• ইসি মনে করে, সংবিধানের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ে তাদের কিছু করার নেই

সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইসি অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশ ও প্রশাসনের ওপর নিজেদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। আবার দায়িত্ব পালন না করলে ইসি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু সে ধরনের বড় কোনো নজিরও স্থাপন করতে পারেনি সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন ইসি। ফলে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে পুলিশ ও প্রশাসনের ওপর ইসি কতটুকু নিয়ন্ত্রণ নিতে পারবে, তা নিয়ে বড় ধরনের সংশয় আছে।

নির্বাচন–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের অভিজ্ঞতা এই সংশয় আরও জোরালো করেছে। সর্বশেষ পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পুলিশের ওপর ইসির নিয়ন্ত্রণ ছিল না। অনেক ক্ষেত্রে ইসির চেয়ে পুলিশকেই বড় ভূমিকায় দেখা যায়। তাই নির্বাচনের সময় স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসনসহ নির্বাচন–সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ কিছু মন্ত্রণালয় ইসির অধীনে আনা প্রয়োজন।

সরকারের শরিকদের পক্ষ থেকেও নির্বাচনের সময় স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসনসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলো নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অধীনে আনার সুপারিশ ছিল। বিশেষ করে পুলিশ ও প্রশাসনকে সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রেখে স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে এই সুপারিশ করা হয়। সরকার ও বিরোধী দলে থাকা জাতীয় পার্টি (জাপা), সরকারের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক গণতন্ত্রী পার্টিও এই সুপারিশ করেছিল।

গত বছর ইসির সংলাপে অংশ নিয়ে ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ১২টি দল এই সুপারিশ করে। এ ছাড়া সুশীল সমাজ এবং নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ একই সুপারিশ করেন। তবে সংলাপ শেষে ইসি এই সুপারিশকে সংবিধানের সঙ্গে সম্পর্কিত হিসেবে চিহ্নিত করে। কমিশন মনে করে, সংবিধানের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে তাদের কিছু করার নেই।

এর আগে ২০১১ সালে এ টি এম শামসুল হুদা কমিশনও স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসনসহ ছয়টি মন্ত্রণালয় নির্বাচনের সময় ইসির তত্ত্বাবধানে দিয়ে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের সুপারিশ করেছিল। কিন্তু সরকার তা রাখেনি। আর বর্তমান কমিশন এ বিষয়ে আলোচনা করতেও রাজি হয়নি। স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ইসির অধীনে আনাসহ ৫টি প্রস্তাব নিয়ে ১৫ অক্টোবর কমিশনের সভায় আলোচনা করতে চেয়েছিলেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। কিন্তু অন্য কমিশনারদের আপত্তির কারণে তিনি প্রস্তাবগুলো সভায় তুলতে পারেননি। এর প্রতিবাদে তিনি সভা বর্জন করেন।

পরে আরেক নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম সাংবাদিকদের বলেন, স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ইসির অধীনে আনার প্রস্তাব সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ, সংবিধান অনুযায়ী এটা প্রধানমন্ত্রীর কাছে ন্যস্ত।

বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত বছর নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের সঙ্গে সংলাপ করেছিল। সংলাপের সুপারিশগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, জাপা, ওয়ার্কার্স পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টি ছাড়াও বিএনপি, খেলাফত মজলিস, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, ইসলামী ফ্রন্ট, ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ নির্বাচনের সময় গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলো ইসির অধীনে আনার প্রস্তাব করেছিল।

সুপারিশে জাপা বলেছিল, নির্বাচনকালীন প্রয়োজনে সংবিধানের ধারা–উপধারা সংশোধন করে হলেও স্থানীয় সরকার, জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশনের অধীনে নিয়ে আসতে হবে। এই প্রস্তাবের যৌক্তিকতা সম্পর্কে জানতে চাইলে জাপার কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের প্রথম আলোকে বলেন, জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সরাসরি নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত। দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা হলো, এখানে দল ও সরকার মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তাই দলীয় সরকারের অধীনে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা পক্ষপাতমূলক আচরণ করতে পারেন। কর্তৃত্ব ইসির কাছে থাকলে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা নিরপেক্ষভাবে কাজ করার সুযোগ পাবেন।

ওয়ার্কার্স পার্টি বলেছিল, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নির্বাচনকালীন ইসির অধীনে থাকবে। একই প্রস্তাব ছিল গণতন্ত্রী পার্টির। ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা প্রথম আলোকে বলেন, যাতে নির্বাচনের সময় ইসি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, এ জন্য তাঁরা এই প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

বিএনপি বলেছিল, নির্বাচনের ৯০ দিন আগে স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, অর্থ, তথ্য, প্রতিরক্ষা, স্থানীয় সরকার, শিক্ষা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, পররাষ্ট্র, কৃষি, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ৫ ধারা অনুযায়ী ইসির চাহিদা অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য থাকবে। নতুন সরকার দায়িত্ব না নেওয়া পর্যন্ত এই ব্যবস্থা বলবৎ রাখতে হবে।

সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। আর আরপিওর ৫ ধারায় আছে, ইসি যেকোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষকে তার প্রয়োজন অনুযায়ী চাইতে পারবে। সরকারের সব নির্বাহী বিভাগ নির্বাচনের কাজে ইসিকে সহযোগিতা করবে। এ লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি ইসির সঙ্গে আলাপ করে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতে পারবেন।

নির্বাচনের সময় পুলিশ ও প্রশাসনের ওপর ইসির কতটুকু নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়, তা নিয়ে ইসিতেই প্রশ্ন আছে। এর আগে একবার নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের জন্য সেনাবাহিনী চেয়েও পায়নি ইসি। গাজীপুরে একজন পুলিশ কমিশনারকে বদলি করাতে পারেনি ইসি। স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে বর্তমান কমিশনকেও নিজেদের আইনি ক্ষমতা অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে দেখা যায়নি। খুলনা সিটি নির্বাচনে কয়েকটি কেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগে সেখানকার পুলিশ কমিশনারকে তলব করার সিদ্ধান্ত নিলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।

নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন অনুযায়ী, নির্বাচনী কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তারা নির্বাচন কমিশন ও রিটার্নিং কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রণে থাকবেন এবং তাদের যাবতীয় আইনানুগ আদেশ বা নির্দেশ পালনে বাধ্য থাকবেন। এই আদেশ পালনে ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ ব্যর্থ হলে বা অস্বীকৃতি জানালে তা হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ জন্য কমিশনের অনুরোধে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ ওই কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে অপসারণ বা বরখাস্ত বা বাধ্যতামূলক অবসর দিতে পারবে। আর কমিশন বা কমিশনের সম্মতিক্রমে রিটার্নিং কর্মকর্তা সর্বোচ্চ দুই মাসের জন্য চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ দিতে পারবেন।

ইসির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মাহবুব তালুকদার যে প্রস্তাব ১৫ অক্টোবরের সভায় তুলতে চেয়েছিলেন, সেখানে তিনি এই বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাঁর প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, অতীত নির্বাচনগুলোতে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ভাঙার দায়ে ইসি পুলিশ ও প্রশাসনের কতজনের বিরুদ্ধে বা কতগুলো ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিতে পেরেছে, তা জিজ্ঞাস্য। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় ইসি অনেক ক্ষেত্রে ইচ্ছা অনুযায়ী ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে না। এর কারণ কাগজে–কলমে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ইসির অধীনে ন্যস্ত হলেও বাস্তবে কমিশন তাদের ওপর খুব একটা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে না। সিটি করপোরেশনের নির্বাচনগুলোতে তা খুবই স্পষ্ট হয়েছে।

জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সহযোগিতা করার কথা বলা থাকলে বা অনেক আইন থাকলেও তা মানা হয় না। যে কারণে এই আলোচনা এসেছে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইসি সেনাবাহিনী চেয়েছিল কিন্তু দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন কোনো মন্ত্রণালয় চালাবে না। তারা তত্ত্বাবধান করবে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ইসির সঙ্গে আলোচনা করে নেবে। ২০১১ সালে তাঁরা দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকার, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ ছয়টি মন্ত্রণালয় ইসির তত্ত্বাবধানে এনে আরপিও সংশোধনের সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। ভারতে নির্বাচনের সময় ইসির মতামত নিয়েই মন্ত্রণালয়গুলো সিদ্ধান্ত নেয়।