পোশাক মালিকদের পিছটান

রানা প্লাজা ধস
রানা প্লাজা ধস

শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ প্রদানে ক্রেতারাই ভরসা!
 বিজিএমইএ ১৪ কোটি টাকা খরচ করে দায়িত্ব শেষ করেছে
 প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ১২৭ কোটি টাকা জমা, খরচ ২২ কোটি
 চার কোটি ডলারের আন্তর্জাতিক তহবিল গঠন নিয়ে সংশয়

সাভারের রানা প্লাজা ধসের এক বছর হলে গেলেও এখনো এ ঘটনায় হতাহত শ্রমিকদের পরিবার ন্যায্য ক্ষতিপূরণ বুঝে পায়নি। এমনকি কে কত ক্ষতিপূরণ পাবেন, তা-ও চূড়ান্ত হয়নি। এরই মধ্যে পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়ে পিছটান দিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকেও সুস্পষ্ট বা শক্ত কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। ক্ষতিপূরণ দিতে বিদেশি ক্রেতাদের দিকেই তাকিয়ে আছে সরকার, বিজিএমইএ ও শ্রম সংগঠনগুলো।
ক্ষতিপূরণের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে একটি তহবিল গঠিত হলেও অনেক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান এতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ফলে চার কোটি ডলারের এই তহবিল গঠন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। তহবিলে এখন পর্যন্ত ক্রেতারা দেড় কোটি ডলার দিয়েছে। এর বাইরে প্রাইমার্ক আলাদা করে দিয়েছে ৯০ লাখ ডলার। এ থেকে ক্ষতিপূরণের অংশ হিসেবে শ্রমিকদের অগ্রিম ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া শুরু হয়েছে।
গত বছরের ১৪ জুলাই জাতীয় সংসদে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী জানিয়েছিলেন, রানা প্লাজার ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা পড়েছে ১২৭ কোটি ৬৭ লাখ ৩৩ হাজার ৩৪৯ টাকা। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর গত সপ্তাহ পর্যন্ত খরচের একটি হিসাব শ্রম মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। বিজিএমইএ সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, এ তহবিল থেকে হতাহতদের অর্থসহায়তাসহ এ পর্যন্ত ২২ কোটি ১৩ লাখ ৫৫ হাজার ৭২০ টাকা খরচ করা হয়েছে। অনেকেই এই তহবিল থেকে এখনো অনুদান পাননি।
দেশের পোশাক খাতের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনাটি ঘটে গত বছরের ২৪ এপ্রিল। নয়তলা রানা প্লাজা ধসে মারা যান ভবনটিতে অবস্থিত পাঁচ পোশাক কারখানার এক হাজার ১৩৫ জন শ্রমিক। আহত হন এক হাজার ১৬৭ জন শ্রমিক, গুরুতর আহত ছিলেন ৮১ জন। এখনো ৭৪টি লাশের পরিচয় জানা যায়নি।
এ ঘটনার পর বিশ্বে আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় ওঠে। এক বছর ধরেই রানা প্লাজা নিয়ে অব্যাহতভাবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে লেখালেখি হচ্ছে। শ্রমিকের নিরাপত্তার ইস্যুতে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প প্রশ্নবিদ্ধ হয়। চাপে পড়ে পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়নে কাজ শুরু করতে বাধ্য হন মালিকেরা।
অবশ্য ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়ে ‘বাধ্য’ করা যায়নি মালিকপক্ষের প্রতিনিধিত্বকারী বিজিএমইএকে। হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে একটি উদ্যোগ নেন, গঠন করা হয় একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি। কমিটি হাইকোর্টে প্রতিবেদন জমা দিলেও এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি। ফলে ক্ষতিপূরণের বিষয়ে এখনো আইনি বাধ্যবাধকতাও তৈরি হয়নি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) সহকারী নির্বাহী পরিচালক সুলতান উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সব পক্ষই ক্ষতিপূরণকে একটি দান হিসেবে নিয়েছে। দায়িত্ব নিয়ে কেউ কাজ করছে না। ফলে পুরো প্রক্রিয়াটি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
বিজিএমইএ নিশ্চুপ: রানা প্লাজা ধসের পর একটি সহায়তা তহবিল গঠন করে বিজিএমইএ। প্রতিটি সদস্যকে ন্যূনতম ২৫ হাজার টাকা করে তহবিলে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। পাঁচ হাজার ৪০০ সদস্যের মধ্যে বিজিএমইএর তহবিলে মাত্র এক হাজার ৮৪২ সদস্য সাড়ে ১৪ কোটি টাকা টাকা জমা দেয়। এর মধ্যে বিকেএমইএ দেয় এক কোটি টাকা।
বিজিএমইএর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ওই তহবিল থেকে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসায় তিন কোটি ৯০ লাখ, বেতন-ভাতা সাত কোটি ৬০ লাখ, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা দুই কোটি, প্রসূতি শ্রমিকদের সহায়তায় চার লাখ ২০ হাজার এবং উদ্ধার ও পুনর্বাসনকাজে ৯৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়। তবে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়ে বিজিএমইএ নেতারা নিশ্চুপ।
জানতে চাইলে বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম প্রথম আলোকে বলেন, আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকলেও নিজেদের দায়িত্ববোধ থেকেই সামর্থ্য অনুযায়ী শ্রমিকদের বেতন-ভাতা, আহতদের চিকিৎসাসহ বিভিন্ন কাজ করেছে বিজিএমইএ।
বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার বলেন, বিজিএমইএ যা করছে, তা লজ্জাজনক। মালিকদের সংগঠনের সামর্থ্য মাত্র সাড়ে ১৪ কোটি, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এক বাটেক্সপোর ফ্যাশন শোর জন্যই তো বিজিএমইএ কোটি কোটি টাকা খরচ করে।
ক্ষতিপূরণ দিতে আগ্রহ না দেখালেও রানা প্লাজা ধসের পর পোশাকশিল্পের সংকট ও সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিপুল ক্ষতির তথ্য দেখিয়ে মালিকেরা সরকারের কাছ থেকে ঠিকই সুবিধা আদায় করে নিয়েছেন। এর মধ্যে আছে মোট রপ্তানি মূল্যের ওপর উৎসে কর দশমিক ৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক ৩ শতাংশ করা। শিগগিরই এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হবে।
এই ছাড় দেওয়ায় পোশাকমালিকেরা কী পরিমাণ আর্থিক সুবিধা পাবেন এবং সরকার কতটা রাজস্ব বঞ্চিত হবে, এর একটি হিসাব করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সে অনুযায়ী, নতুন করহার বাস্তবায়িত হলে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত ১৫ মাসে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হবে সরকার। শুধু পোশাকমালিকদের কাছ থেকেই সরকারের রাজস্ব কমবে এক হাজার ৮১০ কোটি টাকা।
আইনি বাধ্যবাধকতা হয়নি: প্রত্যেক নিহত, নিখোঁজ শ্রমিকের পরিবার এবং স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যাওয়া শ্রমিক ১৪ লাখ ৫১ হাজার ৩০০ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন। আর আহত হওয়ার ধরন অনুযায়ী শ্রমিকেরা পাবেন দেড় লাখ থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে সাত লাখ টাকা।
হাইকোর্টের বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের বেঞ্চের স্বতঃপ্রণোদিত রুলের পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত কমিটির সুপারিশ এটি। এখনো এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেননি হাইকোর্ট। ওই কমিটির সদস্য বিজিএমইএর প্রতিনিধি চূড়ান্ত সুপারিশে স্বাক্ষর করলেও তাতে লিখে দেন, ক্ষতিপূরণ শ্রম আইন অনুযায়ীই হতে হবে।
তবে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ উপকমিটির প্রধান এম এম আকাশ প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষতিপূরণের অর্থ কে দেবেন, সে সিদ্ধান্ত দেবেন হাইকোর্ট। তবে ইতিমধ্যে হাইকোর্ট এ ঘটনার জন্য ভবনমালিক, দায়িত্বে অবহেলা করা সরকারি কর্মকর্তা ও বিজিএমইএর দিকে অঙ্গুুলি নির্দেশ করেছেন। আর যারা দায়ী তারাই তো ক্ষতিপূরণ দেবেন। তিনি জানান, হাইকোর্টের নির্দেশে এরই মধ্যে ভবনমালিক সোহেল রানার ব্যক্তিগত ছয় বিঘা জমি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
ক্রেতাদের উৎসাহে ভাটা: আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গঠিত রানা প্লাজা অ্যারেঞ্জমেন্ট কো-অর্ডিনেশন কমিটির তথ্য অনুযায়ী, ক্ষতিপূরণের জন্য গঠিত ‘রানা প্লাজা ডোনারস ট্রাস্ট ফান্ড’-এ এখন পর্যন্ত প্রায় এক কোটি ৫০ লাখ ডলার জমা পড়েছে। রানা প্লাজার পাঁচ কারখানায় পোশাক তৈরি করাত ২৯ ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ১৬ প্রতিষ্ঠান তহবিলে অর্থও দেয়নি, কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি।
অ্যারেঞ্জমেন্ট কো-অর্ডিনেশন কমিটির সভাপতি করা হয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাকে (আইএলও)। ২৮ জানুয়ারি এই তহবিল গঠিত হয়। তারও আগ থেকেই এ বিষয়ে প্রচারাভিযান চালাচ্ছে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনগুলো। চার কোটি ডলারের তহবিল গঠন করা হলেও তিন মাসে জমা পড়েছে এর এক-তৃতীয়াংশ। এটা হতাহতদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া বিষয়ে ক্রেতাদের আগ্রহে ভাটা পড়াকেই সামনে নিয়ে এসেছে।
যদিও আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইনের আন্তর্জাতিক সমন্বয়কারী ইনেকে জেলডারনাস সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বলেছেন, ওই ২৯ ব্র্যান্ড বছরে দুই হাজার ২০০ কোটি ডলার মুনাফা করে। আর এই মুনাফার শূন্য দশমিক ২ শতাংশ দিলেই ক্ষতিপূরণের সমস্ত টাকা উঠে আসার কথা।
ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলোর এই তহবিলে অর্থ না দেওয়া প্রসঙ্গে কল্পনা আক্তার বলেন, ‘আমরাও ছেড়ে দেব না। যত দিন অর্থ না দেবে তত দিন তাদের যে যে উপায়ে বিব্রত করা যায়, আমরা তার সবই করব।’
ক্রেতাদের মধ্যে ব্যতিক্রম প্রাইমার্ক। আয়ারল্যান্ডভিত্তিক এই খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিপূরণ বাবদ ৯০ লাখ ডলার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এই অর্থে রানা প্লাজার দ্বিতীয় তলায় থাকা নিউ ওয়েভ বটমস লিমিটেডের ৫৮০ জন শ্রমিকের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। তহবিলে না দিয়ে প্রাইমার্ক নিজেই আইএলওর নির্দেশনা অনুযায়ী শ্রমিকদের এই অর্থ পৌঁছে দেবে। অবশ্য অ্যারেঞ্জমেন্ট কমিটি বলছে, প্রাইমার্ক দেবে ৭০ লাখ ডলার। এর বাইরে তহবিলে সরাসরি ১০ লাখ ডলার দিয়েছে প্রাইমার্ক। এর আগে তিন হাজার ৬৩৯ জনকে তিন কিস্তিতে ৪৫ হাজার করে টাকা দেয় প্রতিষ্ঠানটি।
প্রথম কিস্তি ৫০ হাজার: ট্রাস্ট ফান্ড থেকে তিন হাজার ৬৩৯ জনকে ক্ষতিপূরণের অংশ হিসেবে অগ্রিম ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে ৪০০ জনকে বিকাশের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। বাকিদেরও টাকা দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
এদিকে ক্ষতিপূরণের দেওয়ার জন্যও সাভার সেনানিবাসে ক্ষতিগ্রস্তদের কাছ থেকে গত মাসের শেষের দিকে দাবিনামার বা ক্লেইম ফরম পূরণ শুরু হয়েছে। নিখোঁজদেরও এই তালিকার আওতায় নেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যেক উত্তরাধিকারের জন্য আলাদা ব্যাংক হিসাব খুলে দেওয়া হচ্ছে।
ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের মহাসচিব রায় রমেশ চন্দ্র বলেন, ‘দাবিনামার ফরম পূরণ হলেই জানা যাবে কে, কত ক্ষতিপূরণ পাবেন। হতাহত প্রত্যেক শ্রমিকের ক্ষতিপূরণ ভিন্ন হবে। সে ক্ষেত্রে মোট ক্ষতিপূরণের অর্থের সঙ্গে এই ৫০ হাজার টাকা সমন্বয় করা হবে। আর তহবিলে প্রত্যাশিত অর্থ জমা না পড়লে আমরা ক্ষতিপূরণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের বাকি অর্থ দাবি করব।’