অনিয়ম দেখেও নীরব থাকে ইসি

চট্টগ্রামের পটিয়া পৌরসভা নির্বাচনে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের একটি দৃশ্য
ফাইল ছবি

পৌরসভা নির্বাচনে ভোট কেমন হবে, তার ইঙ্গিত বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের বক্তব্যে আগেই পাওয়া যাচ্ছিল। গত রোববার চতুর্থ ধাপে অনুষ্ঠিত ৫৫টি পৌরসভা নির্বাচনের আগেই প্রকাশ্যে নৌকায় ভোট দেওয়া, কেন্দ্রে আসার আগেই ভোটারদের আটকে দেওয়া এবং বিএনপির নেতা-কর্মীদের এলাকাছাড়ার হুমকি দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের তিনজন নেতা। এসব ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন (ইসি) কার্যত কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় ভোটের দিন অনেক পৌরসভাতেই ওই নেতাদের বক্তব্যের প্রতিফলন ঘটতে দেখা গেছে।

যদিও চতুর্থ ধাপের ভোটে অনিয়ম, সংঘাত হবে না বলে আশার বাণী শুনিয়েছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বলা হয়েছিল, ভোটকেন্দ্রে গোপন বুথের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ভোটের আগে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী কর্মকর্তা, পুলিশ ও প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন নির্বাচন কমিশনাররা। তবে পরিস্থিতি বদলায়নি। সংঘাত, প্রাণহানি, ভোটকেন্দ্রে বিএনপির এজেন্ট ঢুকতে না দেওয়া, পছন্দমতো ভোট দিতে না পারা এবং গোপন বুথে নৌকা প্রতীকের সমর্থকদের অবস্থান নেওয়াসহ নানা অনিয়ম দেখা গেছে।

চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা, লক্ষ্মীপুরের রামগতি এবং ঠাকুরগাঁওয়ের পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তিন নেতার বক্তব্যের ভিডিও ভোটের আগেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল (ছড়িয়ে পড়া) হয়। যেখানে চুয়াডাঙ্গার আওয়ামী লীগ নেতা প্রতিপক্ষকে ভয়ভীতি ও দলীয় কর্মীদের অনিয়ম করে ভোট দেওয়ার ‘কৌশল’ বলে দেন। লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের নেতা বলেছেন, ইভিএমে নৌকার বাইরে ভোট দিলে ধরে ফেলা যায়। আর ঠাকুরগাঁওয়ে গিয়ে মহিলা আওয়ামী লীগের এক নেত্রী বলেছিলেন, নৌকায় ভোট না দিলে ভোটকেন্দ্রে আসার দরকার নেই। তিনটি ঘটনাতেই ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে ইসি কার্যত নীরব ছিল।

এসব বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনের অধঃপতনের যেটুকু বাকি ছিল, এবারের পৌর নির্বাচনে তা হয়ে গেছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বিভিন্ন জায়গায় যেভাবে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার বিষয়ে ইসি কী ব্যবস্থা নিয়েছে? ইসির নিয়ন্ত্রণ থাকলে এগুলো হয় কী করে? তিনি বলেন, গণমাধ্যমে খবর আসছে, বুথে একজন ‘সহযোগিতা করার’ জন্য বসে থাকেন। যেসব কেন্দ্রে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে বলে পত্রপত্রিকায় এসেছে, সেখানকার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলো না কেন? ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি এমনই থাকবে।

গত রোববার অনুষ্ঠিত ঠাকুরগাঁও পৌরসভা নির্বাচনে পথে পথে ভোটারদের বাধা দিতে দেখা গেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় ভোটারদের প্রকাশ্যে ভোট দিতে চাপ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সেখানে একটি কেন্দ্রে মেয়র পদের ইভিএম যন্ত্র গোপন কক্ষের বাইরে রেখে ভোট নিতে দেখা গেছে। বিভিন্ন জায়গায় ভোট দেওয়ার গোপন বুথে ক্ষমতাসীন দলের কর্মী–সমর্থকেরা অবৈধভাবে অবস্থান করছিলেন। ঠাকুরগাঁও পৌরসভার আর কে স্টেট উচ্চবিদ্যালয়ের কেন্দ্রসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় বুথে অবস্থানকারীরা বলেছেন, তাঁরা ‘ভোটারদের সহযোগিতা’ করছেন। এর আগের ধাপের নির্বাচনগুলোতেও অনেক পৌরসভায় একই ধরনের চিত্র দেখা গেছে।

আইন অনুযায়ী, ভোট হবে গোপন ব্যালটে। ভোটের গোপনীয়তা রক্ষায় ব্যর্থতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কোনো রিটার্নিং কর্মকর্তা, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা, প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, পোলিং কর্মকর্তা কিংবা ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত কোনো প্রার্থী, নির্বাচনী এজেন্ট বা পোলিং এজেন্ট ভোটের গোপনীয়তা রক্ষা করতে কিংবা রক্ষায় সাহায্য করতে ব্যর্থ হলে ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের বিধান আছে।

তবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনের অনেক বিধি বরং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য বৈষম্যমূলক। আচরণবিধির কারণে মন্ত্রী–সাংসদেরা প্রচারে অংশ নিতে পারছেন না। বিএনপি সে ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা ভোগ করছে। তিনি বলেন, বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে নামকাওয়াস্তে। যেমন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মতো দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরের ভোটে তাদের দলের মহাসচিব বা জ্যেষ্ঠ নেতাদের প্রচারে দেখা যায়নি। এমনকি চট্টগ্রামের স্থানীয় জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকেও মাঠে নামেননি। এ রকম সব নির্বাচনেই তারা অংশ নিচ্ছে নামকাওয়াস্তে।

আইন অনুযায়ী, ভোট হবে গোপন ব্যালটে। ভোটের গোপনীয়তা রক্ষায় ব্যর্থতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কোনো রিটার্নিং কর্মকর্তা, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা, প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, পোলিং কর্মকর্তা কিংবা ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত কোনো প্রার্থী, নির্বাচনী এজেন্ট বা পোলিং এজেন্ট ভোটের গোপনীয়তা রক্ষা করতে কিংবা রক্ষায় সাহায্য করতে ব্যর্থ হলে ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের বিধান আছে। চার ধাপের পৌরসভা নির্বাচনে বিভিন্ন জায়গায় ভোটের গোপনীয়তা লঙ্ঘনের অভিযোগ এলেও এই ক্ষমতার প্রয়োগ দেখা যায়নি। চতুর্থ ধাপের ভোটে মোট সাতটি কেন্দ্রে ভোট স্থগিত করা হয় মূলত ব্যালট ছিনতাইয়ের অভিযোগে।

এসব বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনে ইসির যেটুকু নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত, ততটুকু রয়েছে। যেখানে তথ্যপ্রমাণসহ অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে, সেখানে ভোট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যেখানে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি, সেখানে স্থগিত করা হয়নি। কিছু অভিযোগ এখন শোনা যাচ্ছে। ফলাফলের গেজেট হওয়ার আগেও কেউ যদি তথ্যপ্রমাণসহ অভিযোগ করেন, ইসি তা খতিয়ে দেখবে। তিনি বলেন, কোথাও যদি কোনো কর্মকর্তার ভোটের গোপনীয়তা রক্ষায় ব্যর্থতার সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়, অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও সংসদের উপনির্বাচনগুলোতে ভোটার খরা দেখা দিয়েছিল। তবে এবারের পৌরসভা নির্বাচনে সে খরা কেটেছে। ভোটার উপস্থিতি বেড়েছে, কিন্তু অনিয়মও অব্যাহত আছে। ইসির তথ্য অনুযায়ী, চতুর্থ ধাপের পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে ভোট পড়েছে ৬৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ। সর্বোচ্চ ভোট পড়েছে বরিশালের বানারীপাড়ায়, ৯২ দশমিক ৬০ শতাংশ। আর সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে চট্টগ্রামের পটিয়ায়, ৪৬ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। এখানে নির্বাচনী সংঘাতে একজনের মৃত্যু হয়। এর আগে প্রথম ধাপে ৬৫ শতাংশ, দ্বিতীয় ধাপে ৬১ দশমিক ৯২ শতাংশ এবং তৃতীয় ধাপে ৭০ দশমিক ৪২ শতাংশ ভোট পড়েছিল। ওই সব নির্বাচনেও একই ধরনের অনিয়ম দেখা গেছে।

চার ধাপের নির্বাচনে মেয়র পদে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ১৫৫টিতে জয় পেয়েছে। বিএনপি জয়ী হয়েছে ১০টি পৌরসভায়, আর স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছেন ৩০টিতে। এর বাইরে জাতীয় পার্টির একজন এবং জাসদের একজন মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন।

পৌরসভা নির্বাচনের ফলাফল দেখে আমার ধারণা হচ্ছে, নির্বাচন নির্বাসনে যেতে চায়।
মাহবুব তালুকদার, নির্বাচন কমিশনার

পৌর ভোট নিয়ে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রথম আলোকে বলেন, ভোটারদের ভোট দেওয়ার অধিকার থেকে বিরত রেখে একটি সন্ত্রাসী নির্বাচন হচ্ছে। ইসি বিশেষ করে সিইসি সে নির্বাচনকে উৎসাহিত করছেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ নিজেরা মারামারি করে মানুষ খুন করছে। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে গণতান্ত্রিক স্পেসের জন্য। কিন্তু ন্যূনতম কোনো নির্বাচনী পরিবেশ নেই। নির্বাচন কমিশন পুরোপুরি সরকারের আজ্ঞাবাহী।

চার ধাপের পৌর নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের প্রায় ৬০ শতাংশই পেয়েছেন নৌকার প্রার্থীরা। অনেকগুলো পৌরসভায় বিএনপির প্রার্থীরা জামানত হারিয়েছেন। নির্বাচনের এই ফল নিয়েও অনেকের মধ্যে প্রশ্ন আছে। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারও তাঁদের একজন। গতকাল তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘পৌরসভা নির্বাচনের ফলাফল দেখে আমার ধারণা হচ্ছে, নির্বাচন নির্বাসনে যেতে চায়। নির্বাচন অর্থ অনেকের মধ্য থেকে ভোটের মাধ্যমে বাছাই। কিন্তু সে অবস্থা আজকাল পরিলক্ষিত হয় না। প্রশ্ন জাগে, নির্বাচন কি এখন পূর্বে নির্ধারিত?’

মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘প্রায় সব নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে বলে আমরা তৃপ্তি বোধ করি। কিন্তু নির্বাচন বিষয়ে আমাদের সব দাবি জনগণের উপলব্ধির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।’