পৌরসভায় সিইও নিয়োগ, ‘অস্বস্তিতে’ মেয়ররা

  • দেশে পৌরসভা ৩২৮টি।

  • ‘ক’ শ্রেণির পৌরসভা ১৯৪টি।

  • আগেই সিইও ছিল ৪ পৌরসভায়।

  • এ মাসে আরও দুটি পৌরসভায় সিইও নিয়োগ।

দেশের প্রথম শ্রেণির পৌরসভাগুলোতে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বলছে, পৌরসভার সার্বিক কার্যক্রম গতিশীল করতে এবং স্বচ্ছতা আনতে এই উদ্যোগ। তবে বিষয়টি নিয়ে পৌর মেয়ররা অস্বস্তিতে রয়েছেন। তাঁদের মতে, আমলাতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে পৌরসভায় সিইও নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।

দেশের অধিকাংশ পৌরসভার আয়ের ঘাটতি থাকায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা অনিয়মিত। রাজস্ব আদায়ের অনেক ক্ষেত্র থাকার পরেও পৌরসভাগুলোর আয় বাড়ছে না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রধান নির্বাহী না থাকায় পৌরসভার আয় বাড়ানোসহ প্রশাসনিক কাজে বিঘ্ন হচ্ছিল। পৌরসভার কার্যক্রমকে শৃঙ্খলায় আনতে প্রধান নির্বাহী নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।

পৌরসভার মেয়ররা বলছেন, আমলাতন্ত্রকে শক্তিশালী করতেই সিইও নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে

১ জুন মেহেরপুর ও কক্সবাজার পৌরসভায় সরকারের সহকারী কমিশনার পদের দুই কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে দেশের ৩২৮ পৌরসভার মধ্যে ১৯৪টি ‘ক’ শ্রেণির পৌরসভায় প্রধান নির্বাহী পদে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হবে। স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন, ২০০৯-এ বলা হয়েছে, সরকার নির্ধারিত শর্তে পৌরসভায় প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ দেবে। পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাঁর অধীনে থাকবেন।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনেই প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা কাজ করছেন। দেশের চারটি পৌরসভায় (ভোলা, সাভার, নারায়ণগঞ্জের তারাব ও ফরিদপুর) আগে থেকেই প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রয়েছেন।

নারায়ণগঞ্জের তারাব পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পৌরসভাগুলোর নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে সিইও নিয়োগ ভালো সিদ্ধান্ত। বিভিন্ন খাত থেকে রাজস্ব আদায় বাড়াতে এবং উন্নয়ন ফান্ডের ব্যয়ে স্বচ্ছতা বাড়াতে সহায়তা করতে পারবেন সিইওরা।

স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত ২৩ মার্চ স্থানীয় সরকার বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ জনপ্রশাসনসচিবের কাছে চিঠি পাঠান। চিঠিতে পৌরসভায় প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়নের জন্য পর্যায়ক্রমে উদ্যোগ নিতে বলা হয়। তাতে উল্লেখ করা হয়, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদায়ন না করা পর্যন্ত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে জেলা সদরের পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে কর্মরত একজন ‘সিনিয়র সহকারী কমিশনার’ বা ‘সহকারী কমিশনার’কে তাঁর নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে।

স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব (পৌর-১) মোহাম্মদ ফারুক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, পৌরসভার কাজে শৃঙ্খলা আনতেই সিইও নিয়োগ করতে জনপ্রশাসন বিভাগে চিঠি দেওয়া হয়। কাজের চাপ ও আর্থিক সচ্ছলতা বিবেচনায় ধাপে ধাপে দেশের ১৯৪টি পৌরসভায় সিইও নিয়োগ হবে।

পৌরসভার মেয়রদের সংগঠন মিউনিসিপ্যাল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি শ্রীপুর পৌরসভা মেয়র আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রধান নির্বাহী দেওয়ার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া উচিত হবে না। যে পৌরসভার সিইও প্রয়োজন হবে, সে চেয়ে নেবে।’ তিনি বলেন, বিদ্যমান কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরই বেতন-ভাতা দিতে হিমশিম খেতে হয়। প্রথম শ্রেণির গেজেটেড একজন কর্মকর্তার বেতন-ভাতাও তখন পৌরসভার কাঁধে যুক্ত হবে। বেতনের দিক থেকেই আপত্তি বেশি।

তিনটি পৌরসভার মেয়র নাম না প্রকাশের শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, এত বছর সরকার প্রধান নির্বাহী নিয়োগ করেনি। এখন জনপ্রতিনিধিদের চাপে রাখতে আমলারা পৌরসভায়ও প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিচ্ছে। উপজেলা চেয়ারম্যানদের সঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের দ্বন্দ্ব দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। পৌরসভার ক্ষেত্রেও এমন দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে।

পৌরসভা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠন পৌরসভা সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের গত এপ্রিল মাসের তথ্য অনুযায়ী, ১ মাস থেকে ৬০ মাস পর্যন্ত বেতন-ভাতা বকেয়া রয়েছে ১৯০টির বেশি পৌরসভায়।

মেহেরপুর পৌরসভায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ২০ মাসের বেতন-ভাতা বকেয়া। পৌরসভার মেয়র মাহফুজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়মিত বেতন-ভাতা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এর মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তাকে পদায়ন করা হয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে পৌরসভাগুলোকে নতুন করে চাপে পড়তে হবে।

স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা যায়, প্রশাসন ক্যাডার থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত সিইওদের বেতন-ভাতায় যাতে সমস্যা না হয়, সে জন্য অর্থ বিভাগকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। পৌরসভা থেকে তাঁদের বেতন-ভাতা না হলে অর্থ বিভাগ যেন তাঁদের বেতন-ভাতার ব্যবস্থা করে।

পৌরসভায় প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের প্রধান নির্বাহী পদে নিয়োগে অসন্তুষ্ট পৌর সচিবেরাও। এত দিন তাঁরা মেয়রের পাশাপাশি পৌরসভার ঠিকাদারদের বিলসহ অন্যান্য ব্যয়ের ক্ষেত্রে মেয়রের সঙ্গে যৌথ স্বাক্ষর করতেন। প্রধান নির্বাহী নিয়োগ হলে তাঁদের এই ক্ষমতা আর থাকবে না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সিইও নিয়োগ নিয়ে সচিবদের আপত্তি বা ক্ষুব্ধ হওয়ার পেছনে মূল কারণ এটি।

সাধারণত দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তারা পৌরসভার সচিবের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তবে ‘ক’ শ্রেণির পৌরসভায় প্রথম শ্রেণির পদমর্যাদার বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাও সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন।

আইনত সচিবদের সঙ্গে সিইওদের বিরোধের কোনো সুযোগ নেই। পৌরসভার প্রশাসন, স্বাস্থ্য ও প্রকৌশল—তিনটি বিভাগের বিভাগীয় প্রধানেরা সিইওর অধীন থাকেন—প্রশাসন বিভাগের প্রধান সচিব, স্বাস্থ্য বিভাগে প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এবং প্রকৌশল বিভাগে প্রধান প্রকৌশলী। সিইও না থাকলে তাঁরা নিজ নিজ বিভাগের নথি পাঠান মেয়রের কাছে। পৌরসভায় সিইও থাকলে তিন বিভাগের নথি তাঁর কাছে যাবে। তিনি এসব নথি মেয়রের কাছে উপস্থাপন করবেন।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রণালয় পৌরসভাগুলোতে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে প্রধান নির্বাহী নিয়োগ দিচ্ছে। এর ফলে মন্ত্রণালয় থেকে তাঁদের পদায়ন করা কর্মকর্তার সঙ্গেই সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করবে। অন্যদিকে এই নিয়োগ পৌরসভার খরচের খাতও বাড়িয়ে দেবে। তবে আইনকানুন জানা দক্ষ প্রধান নির্বাহী থাকলে তা সব প্রতিষ্ঠানের জন্যই ভালো।