প্রকৃতির সৌন্দর্য পাবেন খৈয়াছড়া ঝরনায়

খৈয়াছড়া ঝরনা। ছবি: লেখক
খৈয়াছড়া ঝরনা। ছবি: লেখক

ছুটির দিন কার না মন চায় বেড়াতে? তাই বন্ধুরা ঠিক করলাম খৈয়াছড়া ঝরনা দেখতে যাব। যে-ই ভাবা সেই কাজ। গেলাম খৈয়াছড়া ঝরনা দেখতে। সেখানে আছে বেশ কয়েকটি ঝরনা। সংখ্যা নিয়ে দ্বিমত আছে, কেউ বলে ৭টা, আবার কেউ বলেন ১১টা ঝরনা রয়েছে। তবে একেকটা ঝরনার সৌন্দর্য একেক রকম।

সবাই মিলে গাড়ি ঠিক করলাম। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের পার হয়ে বড়তাকিয়া বাজার এলাকায় খৈয়াছড়া ঝরনা। চট্টগ্রামের এ কে খান থেকে নোয়াখালীগামী একটি বাসে উঠলাম। এক ঘণ্টার আগেই আমরা পৌঁছালাম খৈয়ছড়া যাওয়ার মূল রাস্তায়। এটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে পূর্ব দিকে। মূল সড়ক থেকে পূর্ব দিকে প্রায় অনেক পথ যেতে হবে। রাস্তার পাশেই কিছু সিএনজি আছে। তারা অর্ধেক রাস্তা পর্যন্ত যায়। প্রতিজন ভাড়া ১৫ টাকা। আমরাও অর্ধেক পথ গাড়িতে করে গেলাম। গাড়ি থেকে নামতেই দেখি কিছু লোক ছোট ছোট বাঁশ বিক্রি করছে। যারাই ঝরনার দিকে যাচ্ছে, সবার হাতেই বাঁশ। আমরাও পাঁচ টাকা দিয়ে কিনে নিলাম বাঁশ। এই বাঁশ ছাড়া আপনি হাঁটতে পারবেন না। যত ভেতরে যাবেন, তত গভীর কর্দমাক্ত মাটি। সেই সঙ্গে ঝরনার পানির স্রোত। সব মিলিয়ে আপনার ভারসাম্য ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই খৈয়াছড়া যাওয়ার আগে অবশ্যই হাতে একটা করে শক্ত লাটি কিংবা বাঁশ নিয়ে যেতে হবে।

আমরাও একইভাবে এগোচ্ছি। যেখানে গাড়ি নামিয়ে দিয়েছে, সেখান থেকে খাবারের হোটেল পর্যন্ত পৌঁছাতে আরও পাঁচ মিনিট হাঁটতে হবে। এরপর এসব হোটেলে দুপুরের খাবার অর্ডার করে যেতে হয়। মোবাইল, ব্যাগ সবকিছু হোটেলের লকারে জমা রেখে যেতে পারবেন। আমরাও তাই করেছি।

এরপর শুরু মূলপর্ব। হোটেলের লোকজনকে জিজ্ঞেস করলাম এখান থেকে ঝরনার কাছাকাছি যেতে কতক্ষণ লাগবে? বললেন, দ্রুত গেলে আধা ঘণ্টা লাগবে। এরপর আমরাও দ্রুত ছুটতে লাগলাম। যত যাচ্ছি তত কঠিন পথ। কোথাও ঝরনার পানি, কোথায় হাঁটুসমান কাদা। অনেকে আবার পিচ্ছিল কাদায় স্লিপ খেয়ে পড়ে গেছে। খুব সতর্কভাবে পা দিতে হয়। পাহাড়ের মাটিগুলো এত শক্ত, যেন পাথর। যেতে যেতে কখনো ঝরনার পানির স্রোত¯দেখে মন জুড়ায়। কখনো পাহাড়ের কঠিন পথ দেখে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করি। মজার বিষয় হচ্ছে, যাওয়ার পথে আমরা অনেকগুলো পাখি আর বানর দেখেছি। বানরগুলোকে দেখে ভীষণ ভালো লাগবে যে কারও। চিড়িয়াখানার বানর আর খোলা বনের বানর দেখার মধ্যেও তফাত আছে।

খৈয়াছড়ার একেকটি ঝরনার সৌন্দর্য একেক রকম। ছবি: লেখক
খৈয়াছড়ার একেকটি ঝরনার সৌন্দর্য একেক রকম। ছবি: লেখক

একসময় চলে এলাম প্রথম ঝরনায়। ওহ! আপনাদের তো বলাই হয়নি। এখানে অনেকগুলো ঝরনা রয়েছে। বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন মত পেয়েছি। কেউ বলে সাতটা, আবার কেউ বলে ১১টা ঝরনা রয়েছে। তবে প্রথম ঝরনাটা নিচে বলে সকলে একটু কষ্ট করলেই দেখতে পারে। এরপরের ঝরনাগুলো দেখতে হলে অনেকটা ঝুঁকি নিতে হবে। কারণ দ্বিতীয় ঝরনা থেকে সব কটি পাহাড়ের ওপর। যত উঁচুতে যাবেন, তত ঝরনা। বৃষ্টির দিন সবকিছু পিচ্ছিল। প্রথম ঝরনায় প্রচুর মানুষ। কারণ, এতটুকুই আসে বেশির ভাগ মানুষ। পর্যটকদের ৯৫ শতাংশ এখান থেকেই তৃপ্তি নিয়ে ফিরে যায়। তবে প্রথম ঝরনাটা দেখতে বেশ। আকারেও বড় মনে হচ্ছে। ঝরনার পানির গতি প্রচুর। মানুষও অনেক। বেশ উৎসব উৎসব মনে হচ্ছে। আমরা এসেছি ১০ জন। চারজন সিদ্ধান্ত নিলাম বাকি ঝরনাগুলো দেখব। অন্যরা সাহস করতে পারছেন না। কয়েকজন পাহাড়ের অর্ধেক উঠে আবার ফেরত গেছে।

যা হোক ওখান থেকে আমাদের খৈয়াছড়া ঝরনার মূল ট্র্যাকিং শুরু করতে হলো। পাহাড়ের গাছগুলোর সঙ্গে মোটা মোটা রশি বাঁধা রয়েছে। রশিগুলো দেখে বোঝা যাচ্ছিল অনেক পুরোনো। নিচ থেকে সেই রশিগুলো ধরে ধরে উঠতে থাকলাম ওপরে। কিছু পথ উঠে দেখি আর রশি নেই। এরপর বাঁশ আর গাছ ধরে ধরে উঠতে থাকলাম। উঠতে উঠতে হাঁপিয়ে গেলাম। মাঝপথে জিরিয়ে নিলাম। এরপর আরও ওপরে উঠলাম। মানুষের হাঁটার চিহ্ন দেখে বুঝতে পারলাম ঝরনা আশপাশেই আছে। একটু পর ঝরনার পানির শব্দ। খুশিতে লাফাচ্ছি। ঝরনার কাছে গেলাম। পানিতে ভিজলাম। প্রকৃতিটাও বেশ সুন্দর। পাহাড়ের অনেক ওপরে। এখানেও দেখলাম ৫–৬ জন ছেলে। ওরা এসেছে কুমিল্লা থেকে। ওদের জিজ্ঞেস করলাম, এটা কয় নম্বর ঝরনা? ওরা বলল, পাঁচ নম্বর। আমরা তখন অবাক। তাহলে বাকিগুলো কি ফেলে এলাম! এরপর আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আর ওপরে যাব না। নিচে নেমে পরের ঝরনাগুলো উপভোগ করেই ফিরব। নিচে নেমে পেলাম চতুর্থ ঝরনা। এখানে অনেকটা সময় ছবি তুলেছি। তবে চারপাশে বেশ অন্ধকার অন্ধকার। একা থাকলে যে কেউ ভয় পাবে দিনের বেলায়ও।

চতুর্থ ঝরনা থেকে তৃতীয় ঝরনায় নামতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। নামার অবস্থা নেই বললেই চলে। আর পাহাড়ের মাটিগুলো মাটি না বলে পাথর বললেও ভুল হবে না। খুব কষ্টে তৃতীয় ঝরনায় এলাম। এখানকার প্রকৃতি উপভোগ করলাম। তবে এ ঝরনার পানিগুলো বেশ ঠান্ডা। চারপাশের দৃশ্য অসাধারণ। পাহাড়ের ওপর থেকে পুরো শহরটা কত সুন্দর লাগছে, সেটা বলে বোঝানো যাবে না। এরপর নিচে নামতেই পেলাম দ্বিতীয় ঝরনা। দেখেই মন জোড়ালো। দ্বিতীয় ঝরনায় বেশ কয়েকটি ছবি তুলে নেমে এলাম সেই প্রথম ঝরনায়। যেখানে সবাই রয়েছে। নিচে নেমে ভাবছি, সৃষ্টিকর্তার কী সুন্দর সৃষ্টি। কী অদ্ভুত! আমাদের চারপাশে কত সুন্দর স্থান রয়েছে। আমরা চাইলেও যা উপভোগ করতে পারি না। এরপর সবাই মিলে হোটেলে এলাম। বিকেল পাঁচটায় আমরা দুপুরের খাবার খেতে বসলাম। খাওয়া শেষ করে আবার সেই আগের কায়দায় বাড়ি ফিরে এলাম।

খৈয়াছড়ায় ঠিক কতটি ঝরনা আছে, তা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। কেউ কেউ বলেন ৭টি, আবার কেউ কেউ বলেন ১১টি ঝরনা রয়েছে। ছবি: লেখক
খৈয়াছড়ায় ঠিক কতটি ঝরনা আছে, তা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। কেউ কেউ বলেন ৭টি, আবার কেউ কেউ বলেন ১১টি ঝরনা রয়েছে। ছবি: লেখক

কীভাবে যাবেন

চট্টগ্রাম শহরের একেখান থেকে ঢাকা, নোয়াখালী, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন লোকাল বাসে ৫০ থেকে ৮০ টাকার মাধ্যমে খৈয়াছড়া রাস্তার মুখে নামবেন। চালকের সহকারী হেলপারকে বললেই নামিয়ে দিবে। একইভাকে ঢাকার যেকোনো বাস কাউন্টার থেকে চট্টগ্রামগামী বাসে উঠবেন। যাওয়ার পথে ঢাকা চট্টগ্রাম রোডে চট্টগ্রামের মিরসরাই পার হয়ে বড়তাকিয়া বাজারের আগে খৈয়াছড়া আইডিয়াল স্কুলের সামনে নামবেন। ওখানে নেমে স্থানীয় লোকদের জিজ্ঞাসা করলেই তারা বলে দেবে কোন পথে যেতে হবে। লোকজন যে রাস্তা দেখিয়ে দেবে, ওই রাস্তার মুখে দাঁড়িয়ে থাকা সিএনজিগুলোতে ১৫ টাকা দিয়ে অর্ধেক রাস্তা পর্যন্ত যায়। সিএনজিগুলোর কাজ শুধু এটাই। বাকি পথ হেঁটে যেতে হবে। ঝরনায় যাওয়ার রাস্তা একটিই, আর পথে আরও অনেক অ্যাডভেঞ্চার–পিয়াসীর দেখা পাবেন, কাজেই পথ হারানোর ভয় তেমন একটা নেই বললেই চলে।

কোথায় থাকবেন

বড়তাকিয়া বাজারে থাকার কোনো হোটেল নেই। কিন্তু আপনি চাইলে চেয়ারম্যানের বাংলোয় উঠতে পারেন। এ ছাড়া মিরসরাই বা সীতাকুণ্ডে আপনি থাকার জন্য বেশ কিছু স্থানীয় হোটেল পাবেন। মিরসরাই বা সীতাকুণ্ডে খাওয়ার জন্য অনেক রেস্টুরেন্টও পাবেন। অথবা আপনি চট্টগ্রাম শহরে চলে আসতে পারেন। বড়তাকিয়া বাজর থেকে গাড়িযোগে চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করলে থাকার অনেক ভালো মানের হোটেল রয়েছে। তা ছাড়া অনেক নামীদামি রেস্তোরাঁও রয়েছে খাওয়ার জন্য।

লেখক: শিক্ষার্থী, বিবিএ অনার্স, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ (৩য় বর্ষ), জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ওমরগনি এমইএস বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, চট্টগ্রাম।