প্রজাপতি, পঞ্চশর এবং আমার ক্রিকেট

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

স্মৃতির পাতাতে ধুলো পড়েছে বেশ। অল্প বয়সী হলেও আমি খানিকটা মনভুলো। তবু ক্রিকেটের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের স্মৃতিচারণা করতে বসলে তা একটু-আধটু মনে পড়ে বৈকি। প্রেমকে ভোলে সাধ্যি কার!

খুব ছোটবেলায় ক্রিকেটের সঙ্গে পরিচয়। আমরা তখন থাকতাম আবাসিক একটা এলাকায়। যশোরে এখনকার মতো যান্ত্রিক প্রতিবেশী তখন ছিল না। খোলা জায়গা দেখলেই বিল্ডিং তুলে দেওয়ার নোংরা প্রয়াস দেখা যেত না। আমার শহরে তখন বাসার সামনে ফাঁকা জায়গা রাখাটাই ছিল চলতি ট্রেন্ড। এমনই একটা আবাসিক এলাকাতে আমার বেড়ে ওঠা। সেই এলাকার বিকেলবেলাতেই ক্রিকেটের সঙ্গে পরিচয়।

আমরা একসঙ্গে যে কয়টি পরিবার বাস করতাম, বেশির ভাগ পরিবারেই আমার সমবয়সী বন্ধু ছিল। শৈশবের সারল্যে সবার সঙ্গেই আমার বোঝাপড়াটা জমে গিয়েছিল, খাতিরও হয়েছিল বেশ। তাই তো ব্যাট-বলের খেলাটা সবাই মিলে খেলতে খুব বেশি সমস্যা হতো না!

ক্রিকেট খেলার সঙ্গে পরিচয় হয় এমনই প্রকৃতিগতভাবে। ক্রিকেট দেখার শুরুটা মামার হাত ধরে। তিনি ছিলেন পাগলাটে ক্রিকেট ফ্যান। পারস্পরিক সংস্পর্শে আমি তার সঙ্গে লেগে থাকতাম ফেভিকলের মতোই। তাই তার এই অমূল্য গুণ আমার মধ্যে সঞ্চারিত হতে খুব সময় নেয়নি। তা খেলাটি আমি বুঝলেও কী, আর না বুঝলেও-বা কী—উদ্‌যাপন তো আর ব্যাখ্যা মানে না!
সাল ২০০৭। আমি তখন ক্রিকেট বলতে বুঝি কেবল ব্যাট আর বল। রাউন্ড দ্য উইকেট, আউটের ধরন এসব ‘জটিল’ বিষয় আস্তে আস্তে বুঝতে শুরু করেছি। এ রকম সময়ে বিশ্বকাপ বলে একটি নাম প্রথম শুনলাম। এখনকার চেয়েও তখন ক্রিকেট নিয়ে উন্মাদনাটা মানুষের মধ্যে বেশি দেখা যেত৷ এখনো যে দেখা যায় না, এমন নয়, কিন্তু এখন দল ভালো সময় পার করলে যে স্রোতটা দেখা যায়, তখন যেকোনো সময়েই একই স্রোত দেখা যেত। হাবিবুল বাশারের হাফ সেঞ্চুরিতে তৃপ্তি খোঁজা ক্রিকেট-জনতার উন্মাদনা বুঝি এমনই! কথার বশে অন্য কথায় চলে যাচ্ছি।

২০০৭ সালের কথা বলছিলাম। সেদিনের সন্ধেটা আমার মনে থাকবে বেশ। নাহ্‌, ভুল বললাম বোধ হয়। সন্ধে নয়, মনে থাকবে সেদিনের রাতটা। ইন্টারনেট ঘেঁটে বলতে হবে বলে তারিখটা বলা আবশ্যক মনে করছি না। কিছুক্ষণ পর আপনারা নিজেরাই বুঝতে পারবেন। আমি তখন ছোট ছিলাম, কে কী ভাবছিল, জানিনে, কিন্তু এই মুহূর্তে এটুকু আন্দাজ করতে পারছি যে সেদিনের ম্যাচটিও সবাই দেখতে বসেছিল সম্মানজনক পরাজয়ের আকাঙ্ক্ষাতেই। কিংবা কে জানে অতি উচ্ছ্বাসী কেউ কেউ হয়তো দুর্গজয়ের পর্বতসমান স্বপ্ন দেখে ফেলেছিল। পর্বত বলছি, কারণ, রাহুল দ্রাবিড়, সৌরভ গাঙ্গুলী, জহির খান, বীরেন্দর শেবাগ, যুবরাজ সিংয়ের দলকে হারানো তো চাট্টিখানি কথা নয়!


সেদিনের রাতটা আমার মনে থাকবে আজীবন৷ সেদিনের বিজয় মিছিলকে মনে হয় চাইলেও কোনো দিন ভুলতে পারব না। প্রত্যেক ক্রিকেটপাগল মানুষের চোখেমুখে আমি যে পাগলামি দেখেছিলাম, দিগ্‌বিজয়ী হওয়ার উদ্দামতা দেখেছিলাম, সেটাই মনে হয় আমাকে পরবর্তী দিনে খেলাটিকে ভালোবাসতে, খেলাটি নিয়ে পাগলামির ফোয়ারা ছোটাতে অনুপ্রাণিত করেছিল, উদ্বুদ্ধ করেছিল।


এরপর সময় সময়ের মতো ছুটে চলেছে, আমিও ছুটে গেছি আমার দৈনন্দিন স্রোতে। মধ্যে পেরিয়েছে আরেকটি বিশ্বকাপ, ২০ ওভারের। আশরাফুল আর আফতাবের তখন বোধ হয় বেশ ভক্তকুল জুটে গেছে৷ এখন স্কোরকার্ড ঘেঁটে কারণ বুঝতে পারলেও তখন বুঝতে পারিনি। এরপর আর আনন্দ করা হয়নি বহুদিন, শুধুই উদ্‌যাপনের উপলক্ষ খোঁজার ছুতোয় টিভির সামনে বসা আমি সেদিনের মতো আরেকটি রাত আর পাইনি অনেক দিন। সদ্য কৈশোরে পা দেওয়ার অপেক্ষায় থাকা আমার তখন তাই নিয়ে সে কী আক্ষেপ!

আমরা থাকতাম ভাড়া বাসায়৷ তত দিনে আগের বাসা পাল্টে নতুন বাসায় উঠেছি। সঙ্গে মগজে জমতে শুরু করেছে ক্রিকেটজ্ঞানের অঙ্কুর। এমন সময় নিউজিল্যান্ড বাংলাদেশে এসেছে। আমি যথানিয়ম মেনে খেলা দেখতে বসে গেছি। সাকিব আল হাসান নামের একজন তখন আমার মধ্যে দাগ কেটে গেছে। নিয়মিত পত্রিকা পড়ে পড়ে ক্রিকেট যেমন বুঝতে শুরু করেছি বেশ, সাকিবকেও চিনতে শুরু করেছিলাম। উন্মাদনাটা ওকে নিয়ে বেশি ছিল আমার তখন, তা আজ অস্বীকার করবার জো নেই।


এ রকম সময়ের একটা কথা না লিখলে অন্যায় হবে, স্মৃতিচারণার নিয়ম মানা হবে না। বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড ম্যাচ দেখতে দেখতে গ্যালারিতে দেখতে পেয়েছিলাম বড় এক ব্যানার ‘দৌড়া বাঘ আইলো’। এই একটি লাইন তখন বেশ ভালো লেগে গিয়েছিল। আমার স্পষ্ট মনে আছে, ক্লাস ফোরের বাংলা বইতে আমি এই একটা লাইন লিখে রেখেছিলাম অন্তত ১০টি জায়গাতে।


মজার দুটি স্মৃতি ভাগ করে নিই। প্রথমটি ২০১১ বিশ্বকাপের। ভারতের যুবরাজ সিংয়ের নাম শুনেছিলাম৷ নতুন জার্সি গায়ে প্রথম ম্যাচ দেখতে বসে যে নামটি উচ্চারণ করলাম, তা হয়ে গেল ‘ইউভরাজ সিং’। দ্বিধায় পড়ে গেলাম, ইউভরাজ আর যুবরাজ যে একই, ঠাওর করতে পারলাম না। অতটা নাম শুনলাম যার, তাকেই ভারত প্রথম ম্যাচে তবে নিল না?


আরেকটি অনেক আগের, প্রথম যখন ক্রিকেট দেখতে শুরু করেছি, তখন৷ সত্যি বলতে আমি ভেবেছিলাম ক্রিকেট খেলাটা হয় দুটি দলের মধ্যে—একটি বাংলাদেশ, আরেকটি বিদেশ! শৈশবে কত আহাম্মকি ভাবনাই না আসে!
যা-ই হোক, ২০১১ গেছে। স্বপ্নের মতো ২০১২-ও কেটে গেছে। তবে স্বপ্নের মধ্যেও এশিয়া কাপ ফাইনালের রাতের গগনবিদারী কান্না আমি যেন আজও শুনতে পাই। তবে সে কান্নাতেও আমি খুঁজে পেয়েছিলাম আগামী দিনের স্বপ্নবুননের খোরাক।

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

আমি বারবার প্রেমে পড়েছি ক্রিকেটের। শালিক পাখির মতো দেখে গেছি ক্রিকেট। যখন ক্রিকেট ম্যাচ থাকত না, চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করেছি। ব্যক্তিজীবনের ডিপ্রেশন কাটাতে কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে বাড়াতে ক্রিকেট দেখার বিকল্প বোধ হয় কিছুই নেই। ক্রিকেট আমাকে দিয়েছেও অনেক কিছু। আমি বাজি ধরে বলতে পারি, ইংল্যান্ড-বাংলাদেশ ২০১৫-এর একটি বিকেল, নিদাহাস ট্রফিতে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে শেষ ম্যাচ জয়ে মাহমুদউল্লাহর মারা ছয়ের সেই রাত আমাকে ক্রিকেট ছাড়া আর এই বিশ্বের কোনো কিছুই দিতে পারবে না।


আবার চিত্র ঘুরিয়ে তিনটে এশিয়া কাপ আর এক নিদাহাস ট্রফির ফাইনাল, আফগানিস্তানের সঙ্গে টেস্টে পরাজয় মিলে পাওয়া দুঃখও ক্রিকেট ছাড়া কেউ দিতে পারবে না। যে সুখ দেখে, দুঃখ দেওয়ার অধিকার যে তার থাকবেই। প্রজাপতি আর পঞ্চশরের নইলে বিরোধ থেকে যাবে না?

*শিক্ষার্থী, বুয়েট