প্রতিবন্ধীদেরও ভাতা পেতে ঘুষ দিতে হয়

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সরকারের বরাদ্দ বাস্তবসম্মত ও পর্যাপ্ত নয় বলে টিআইবির এক গবেষণায় উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সরকারের অপ্রতুল বরাদ্দও যথাযথভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছায় না। ইউনিয়ন পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিরা প্রতিবন্ধীদের ভাতার কার্ড দিতে বেআইনিভাবে টাকা নিচ্ছেন। এমনকি স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের একাংশ প্রতিবন্ধীদের ভাতার অংশবিশেষ আত্মসাৎও করছে।

‘উন্নয়নে অন্তর্ভুক্তি এবং প্রতিবন্ধিতা: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনটি গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলন করে প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত গবেষণাটি পরিচালিত হয়।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভাতায় অনিয়ম, সংখ্যায় বিভ্রান্তি

গবেষণায় বলা হয়, মাঠপর্যায়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভাতা পাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে জনপ্রতিনিধিদের সদিচ্ছার ওপর। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সমাজসেবা কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তদবিরে এমন অনেককে ভাতার কার্ড দেওয়া হচ্ছে, যাঁরা প্রতিবন্ধী নন। ফলে প্রকৃত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা অনেক ক্ষেত্রে কার্ড পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আবার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করতে জনপ্রতিনিধিরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কাছ থেকে ১ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা নিয়ে থাকেন বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সমাজসেবা অধিদপ্তরে নিবন্ধিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা ২১ লাখ ৪৩ হাজার ৩৫৩। অপরদিকে বিশ্বব্যাংক এবং বিভিন্ন এনজিওর প্রাক্কলিত তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির হার মোট জনসংখ্যার ৯ থেকে ১০ শতাংশ। সে হিসাবে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৫৪ লাখ। অর্থাৎ প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর প্রায় ৭ ভাগের ১ ভাগ সমাজসেবা অধিদপ্তরে নিবন্ধন করতে পেরেছেন।

নিবন্ধিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রায় ১৬ শতাংশ এখনো সরকারি ভাতার আওতায় আসেনি। টিআইবির গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রথমবার টাকা নিতে ভাতার বইয়ে সমাজসেবা কর্মকর্তার স্বাক্ষর লাগে। উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তা এবং ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিদের একাংশ প্রথমবারের ভাতার টাকার কিছু অংশ আত্মসাতে জড়িত। প্রথম কিস্তির ২৪ থেকে ৬৭ শতাংশ আত্মসাৎ হয়।

টিআইবি বলছে, বর্তমানে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় মাসে ৭৫০ টাকা করে ১৮ লাখ প্রতিবন্ধীকে ভাতা দেওয়া হচ্ছে। এই ভাতা জীবনধারণের চাহিদা পূরণে অপ্রতুল। মৌলিক চাহিদা বিবেচনা না করে কেবল মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনা করে ভাতার পরিমাণ বাড়ানো হয়। ২০১৬ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, সর্বনিম্ন ক্যালরিসম্পন্ন খাবারের জন্য দৈনিক ৬০ টাকা হিসাবে মাসে ১ হাজার ৮০০ টাকা প্রয়োজন। এখানে বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা বিবেচনা করা হয়নি।

তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করতে জনপ্রতিনিধিরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কাছ থেকে ১ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা নিয়ে থাকেন বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।

ভাতার টাকা পেতে ঘুষ ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তির বিষয়ে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান গত রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ভাতা পেতে ঘুষ দিতে হয়, এটি প্রচলিত কথা হয়ে গেছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিবন্ধন করতে হয়। নিবন্ধিত ব্যক্তিদের ভাতা পেতে কোনো টাকা দিতে হয় না। আর প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা কিছুটা বেশি হতে পারে। আদমশুমারিতেই দেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা উঠে আসে।

সুযোগ-সুবিধায় ঘাটতি

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সেবা দেওয়ার সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রে’ প্রয়োজনীয় জনবলের ঘাটতি রয়েছে বলে টিআইবির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। দেশের ১০৩টি কেন্দ্রের মধ্যে ৯৫টি কেন্দ্রে স্পিচ থেরাপিস্ট এবং ৯৮টি কেন্দ্রে অকুপেশনাল থেরাপিস্টের পদ শূন্য। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে বিতরণের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়ক উপকরণের ঘাটতি রয়েছে। অধিকাংশ বাক্‌শ্রবণ এবং দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের ভবন ও আবাসন জরাজীর্ণ এবং আবাসনের স্বল্পতা রয়েছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের মধ্যে সমন্বয়েরও ঘাটতি রয়েছে। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে গত বছরের এপ্রিল-মে মাস পর্যন্ত প্রতিবন্ধীদের সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রে থেরাপি ও কাউন্সেলিং বন্ধ ছিল।

কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে অধিকাংশ কর্মহীন দরিদ্র পরিবারের পক্ষে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে বেসরকারিভাবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও থেরাপি দেওয়া সম্ভব হয়নি। সরকারিভাবে আড়াই হাজার টাকা অর্থসহায়তা কর্মসূচিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অধিকাংশ প্রান্তিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি যাঁদের কার্ড নেই, তাঁরা আরও বেশি প্রান্তিক হয়েছেন এবং তাঁদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে পরিকল্পনা প্রণয়নে মন্ত্রণালয়, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে।
ফারহানা রহমান, টিআইবির প্রোগ্রাম ম্যানেজার

গতকালের সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নিয়মিত তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ না থাকায় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা ঘটছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। দেশের উন্নয়নপ্রক্রিয়া প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক নয়। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষার কার্যক্রম মূলত সামাজিক সুরক্ষা ও কিছুটা অনুকম্পাসুলভ কার্যক্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

অনুষ্ঠানে গবেষণার ফলাফল ও সুপারিশ তুলে ধরেন টিআইবির প্রোগ্রাম ম্যানেজার ফারহানা রহমান। গবেষণার পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে তিনি বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে পরিকল্পনা প্রণয়নে মন্ত্রণালয়, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। নীতিগত ও আইনগতভাবে গুরুত্ব দেওয়া হলেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কল্যাণে নেওয়া কর্মপরিকল্পনা অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে।

১৪ দফা সুপারিশ

প্রতিবেদনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে অন্তর্ভুক্তি এবং সুশাসনের চ্যালেঞ্জ উত্তরণে টিআইবির ১৪ দফা সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, গণশৌচাগারসহ সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো প্রতিবন্ধীবান্ধব করার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিবন্ধী সংশ্লিষ্ট সেবায় দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শাস্তির আওতায় আনার সুপারিশ করেছে টিআইবি।