রোহিঙ্গা সংকট: প্রত্যাবাসন মনোযোগ হারাচ্ছে

প্রত্যাবাসন নিয়ে বক্তৃতা-বিবৃতি ছাড়া এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তেমন কোনো তৎপরতা নেই।

বাংলাদেশে ২০১৭ সালের আগস্টের পর থেকে রোহিঙ্গাদের যে ঢল নেমেছিল, তাকে গত এক দশকের সবচেয়ে বড় শরণার্থীর ঢল হিসেবে অভিহিত করেছে জাতিসংঘ।
ফাইল ছবি: এএফপি

বাংলাদেশে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা–ঢলের পর থেকেই তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়ায় চীন নেপথ্যে ভূমিকা রাখছে। আর ২০১৮ সাল থেকে দেশটি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আলোচনায় সরাসরি যুক্ত রয়েছে। তবে চীনের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ ভূমিকা সত্ত্বেও কার্যত প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার কিছুই করেনি।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি নৃশংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির বিষয়ে যতটা পদক্ষেপ নিয়েছে, প্রত্যাবাসন নিয়ে বক্তৃতা-বিবৃতি ছাড়া এখন পর্যন্ত তাদের কোনো তৎপরতা নেই। এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ হারাচ্ছে কি না, সেই প্রশ্নটা এখন সামনে চলে এসেছে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের (জেডব্লিউজি) শেষ বৈঠকটি হয়েছিল ২০১৯ সালের মে মাসে। এ বছরের শুরুতে ঢাকায় জেডব্লিউজির বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) কারণে সেই বৈঠক না হওয়ায় দুই দেশের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে কার্যত ১৬ মাস ধরে কোনো আলোচনাই হচ্ছে না। আগামী ৮ নভেম্বর মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচন। যে কারণে আগামী মাস দুয়েকের মধ্যে প্রত্যাবাসন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনাও খুব কম। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় একধরনের অচলাবস্থার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সম্প্রতি চীনের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু করেছে। মিয়ানমারের নির্বাচনের পর প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনায় বসার বিষয়ে বাংলাদেশকে আশ্বাস দিয়েছে চীন।

তবে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির সঙ্গে দেশটির সেনাদের সংঘাত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে আরও জটিল করে তুলেছে। এমন পরিস্থিতিতে ২২ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার আয়োজনে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় দাতাদের বৈঠকে প্রত্যাবাসনের বিষয়টিও অলোচনা গুরুত্ব পাবে, এমন আশাবাদ তৈরি হয়েছিল। তবে ওই আলোচনায় শেষ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তায় নতুন তহবিলের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।

কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, দক্ষিণ এশিয়াসহ চীনের সঙ্গে সারা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈরথ, মিয়ানমার ও যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের সঙ্গে ওই বৈঠকের যোগসূত্রকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের ভোটারদের ট্রাম্প প্রশাসন এই বার্তা হয়তো দিতে চাইছে, বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের নেতৃত্বে থেকে চীনকে প্রতিহত করার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে মিয়ানমারকে এই বার্তা হয়তো যুক্তরাষ্ট্র দিতে চাচ্ছে, তাদের ওপর চাপ বাড়ানো হবে। তবে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বিশেষ করে প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়ায় ওই আলোচনার কোনো ভূমিকা নেই।

রোহিঙ্গা সংকটের সঙ্গে ভূরাজনীতির সম্পৃক্ততার বিষয়ে নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি দেখতে পাচ্ছি সমস্যাটি দীর্ঘায়িত হতে যাচ্ছে। সমস্যাটি নিয়ে ক্ষমতাধর দেশের কাছ থেকে উৎসাহ দেখা যাচ্ছে। আর সেই উৎসাহ রোহিঙ্গাদের নিয়ে যতটা, তার চেয়ে বেশি বড় শক্তিধর দেশগুলোর রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ে। শেষ পর্যন্ত যদি এটি ঘটে যায়, তবে সমস্যা সমাধানের চেয়ে এটি সমস্যাকে আরও ঘনীভূত করবে।’

রোহিঙ্গা সংকটে গত তিন বছরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তাদের মনোযোগের পুরোটা রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করা এবং রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতার জবাবদিহি নিশ্চিত করা। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়নও মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী প্রধানসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তবে দেশটির সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য কিছুই বন্ধ করেনি। সেই অর্থে মিয়ানমারকে রীতিমতো চাপে ফেলে দেওয়ার মতো কোনো পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নেয়নি। এমনকি সম্প্রতি মানবাধিকার বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে অনুষ্ঠিত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সংলাপে রোহিঙ্গা শব্দটি উল্লেখ করা হয়নি। কূটনীতিকেরা বলছেন, প্রকাশ্য বক্তৃতা-বিবৃতিতে চাপের কথা বললেও মিয়ানমারকে কার্যত চটাতে চায় না ইইউ।

সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের ওপর বহুমাত্রিক চাপ বাড়াতে হবে। তবে এখন পর্যন্ত চীনের পাশাপাশি জাপান, ভারতও মিয়ানমারকে নানাভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। যেহেতু ভারত ও জাপানে সক্রিয় নাগরিক সমাজ রয়েছে, তাই এই দুই দেশে জনমত তৈরি করতে হবে। যাতে রোহিঙ্গা সংকটে তারা মিয়ানমারের পক্ষে না থাকে। ভারত ও জাপান যদি মিয়ানমারের কাছ থেকে সরে দাঁড়ায়, তখন এককভাবে চীনের পক্ষে গণহত্যায় অভিযুক্ত একটি দেশকে অব্যাহতভাবে সমর্থন দিয়ে যাওয়াটা দুরূহ হয়ে পড়বে।