প্রথম শহীদ মিনার

সাঈদ হায়দার (১৯২৫—২০২০)

ভোরের রক্তিম আলো ফুটে ওঠার আগেই অবাক বিস্ময়ে মানুষ দেখল দুই মানুষ উঁচু মিনার আকাশের দিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে—বদরুলের যত্নের সঙ্গে ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ লেখা কাগজের ফলকটি বুকে ধারণ করে।

২৩ ফেব্রুয়ারি শনিবারের কথা। এ দিনই শোক থেকে শক্তিতে রূপান্তরিত ৩০০ জোড়া হাত সংঘবদ্ধ হয়েছে একটি আরব্ধ কাজে—শহীদ মিনার গড়তে হবে—গড়তে হবে ওই রক্তরঞ্জিত স্থানে, যেখানে ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ অত্যাচারী সরকারের নির্মম বুলেটের আঘাতে ত্যাগ করেছে শেষনিশ্বাস। কোনো আনুষ্ঠানিক সভা বা সমাবেশে প্রস্তাব নেওয়া হয়নি। ২২ ফেব্রুয়ারির রাত থেকেই যে ইচ্ছেটা স্থান করে নেয় হয়তো মাত্র গোটা কয়েক ছাত্রের মনে তারই প্রতিধ্বনি আজ মেডিকেল ছাত্রাবাসের প্রতিটি ছাত্রকর্মীর হৃদয়ে। অনানুষ্ঠানিক এই সিদ্ধান্তের কথা ব্যাপ্ত হয়ে যায় হোস্টেলের ২৩টি ব্যারাকের প্রতিটি ঘরে রাজনীতিসচেতন বিদ্যার্থীর মধ্যে।

তারপর এল সেই ২৩ ফেব্রুয়ারির অবিস্মরণীয় রাত, বাংলার প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণের রাত। এ রাতেই মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা শহীদ স্মরণে মিনার তৈরি করে আন্দোলনে যোগ করে এক নতুন মাত্রা। নকশা নেই, মজুর নেই, ইট, সিমেন্ট নির্মাণসামগ্রী নেই। কিন্তু যা আছে সে মুহূর্তে তারই তো প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি—মানসিক প্রস্তুতি আর দৃঢ়সংকল্প! কারফিউ জারি ছিল রাস্তায়, সেনাবাহিনীর সাহায্য নিয়েছিল শাসকগোষ্ঠী। বালুচ রেজিমেন্টকে পাল্টে সেদিন টহল দিচ্ছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। মিনার নির্মাণের কাজে কোনো বাধা আসেনি। যদিও হোস্টেলের প্রধান ফটক পেরিয়ে কয়েক গজ পরেই ডান হাতে ১২ নম্বর ব্যারাকের প্রায় সোজাসুজি (স্থানটা বর্তমান মেডিকেল কলেজ ডিসপেনসারির মধ্যে পড়ে) নির্মাণ স্থানটি ছিল টহলরত সৈন্যদের দৃষ্টিসীমার মধ্যেই। মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে হাতে হাতে ইট বয়ে এনেছে হাসপাতাল সম্প্রসারণের কাজের জন্য রাখা স্তূপ থেকে। ঠিকাদার পিয়ারু সর্দারের গুদাম থেকে স্ট্রেচারে বহন করে এনেছে সিমেন্ট আর বালু হোস্টেল আর কলেজের মাঝের গলিপথ দিয়ে, ছাত্ররাই হোস্টেলের ট্যাপ থেকে বলতি ভরে পানি টেনে এনেছে, বালু–সিমেন্টের মর্টার তৈরি করেছে নিজ হাতে, আর তাৎক্ষণিকভাবে নিয়োজিত মাত্র দুজন রাজমিস্ত্রির নিপুণ হাতের সহায়তায় এক রাতে অক্লান্ত পরিশ্রমে সম্পন্ন করেছে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ, করেছে এক অসাধ্যসাধন—বাইরের কারফিউ আর হিমেল হাওয়াকে উপেক্ষা করে। ভোরের রক্তিম আলো ফুটে ওঠার আগেই অবাক বিস্ময়ে মানুষ দেখল দুই মানুষ উঁচু মিনার আকাশের দিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে—বদরুলের যত্নের সঙ্গে ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ লেখা কাগজের ফলকটি বুকে ধারণ করে।

পুরান ঢাকা কলেজ প্রাঙ্গণে ইডেন কলেজের িবজ্ঞান িবভাগের ছাত্রীেদর স্মৃতিস্তম্ভ িনর্মাণ, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩
ছবি: রফিকুল ইসলাম

প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকার স্মৃতি নিয়ে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে পারি, এই মিনার নির্মাণের পরিকল্পনা থেকে শুরু করে নির্মাণ সমাপ্তি পর্যন্ত সব কৃতিত্ব মেডিকেল কলেজ ছাত্রদের একার। অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল বা বিশ্ববিদ্যায়তনের কর্মী বা ছাত্ররা এ কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। প্রথম শহীদ মিনার ছিল মেডিকেল ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ত চিন্তাচেতনার প্রকাশ, তাদের সম্মিলিত শ্রমের ফসল। গোলাম মাওলা ও শরফউদ্দীনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে নির্মাণকাজে সাংগঠনিক শক্তি সঞ্চার করতে পারে, মিনারের নকশা তৈরিতে বদরুল ও আমার সম্পৃক্ততা গৌরবের হতে পারে, আবুল হাশিম আর মনজুরের সবল পেশির সক্রিয়তা নির্মাণে অংশগ্রহণকারীদের উৎসাহিত করতে পারে, আহমদ রফিক, আলী আজগরের সক্রিয়তা এ কাজে সুসমন্বয় আনতে পারে, মামুনুর রশিদ, আবদুর রশিদ, আসাদুজ্জামান, জাবেদ, সিরাজ জিন্নাত, কবির, সালাম, বরকত, হাই, রাকিব, জিয়া, জোরোসহ অনেকের হাত নির্মাণকাজকে ত্বরান্বিত করতে পারে, কিন্তু এ কথা ধ্রুব সত্য যে এর সফল বাস্তবায়নের পেছনে ছিল সব ব্যারাকবাসীর প্রাণের আবেগ ও যৌথ কর্মকুশলতা। প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণের কৃতিত্বের দাবিদার মেডিকেল কলেজের ছাত্রসাধারণ। প্রশ্ন উঠতে পারে, এমন কি গবেষণার বিষয়বস্তুও হতে পারে, কর্মচঞ্চল সেই ২৩ ফেব্রুয়ারির রাতে শহীদ মিনার নির্মাণে কে বেশি অবদান রেখেছিল, কিন্তু যে সত্যটি প্রশ্নাতীত তা হলো এই যে বাংলার সেই প্রথম শহীদ মিনার ছিল সেদিনের মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসের সব ছাত্রের এক যৌথ প্রয়াস। কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতার নির্দেশে নয়, মেডিকেল কলেজ ছাত্রদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও শ্রমেই এক রাতে গড়ে উঠেছিল প্রথম শহীদ মিনার।

স্থাপত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রথম শহীদ মিনারের হয়তো কোনো শৈল্পিক ব্যঞ্জনা ছিল না। দ্রুতগতি যেখানে ছিল ঈপ্সিত লক্ষ্য, সেখানে তা আশা করাও যায় না, কিন্তু এক রাতে মেডিকেল ছাত্রদের সমষ্টিগত শ্রমে গড়া এই শহীদ মিনার এক অসাধ্য সাধন করল, যা ছিল মূলত ছাত্রদের আন্দোলন, তাকে উৎসারিত করে দিল এক গণ–আন্দোলনে, এখানেই এর তাৎপর্য। ত্বরিত গতিতে শহরময় ছড়িয়ে পড়ল শহীদ মিনারের খবর। দলে দলে ছুটে এল মানুষ—বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া, তরুণ-তরুণী, ছোট শিশুর দল শহীদ মিনারের পাদদেশে শহীদদের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা জানাতে। আমাদের হোস্টেল প্রাঙ্গণ পরিণত হলো এক পবিত্র তীর্থক্ষেত্রে। ফুলে ফুলে ঢেকে গেল প্রতিবাদের প্রতীক সেই প্রথম শহীদ মিনার।

২৪ ফেব্রুয়ারি দিনটিতেও পূর্ণ হরতাল পালিত হচ্ছিল, দিনটি ছিল অপেক্ষাকৃত শান্ত অথচ ভাবগম্ভীর। সেদিনের শহীদ মিনার আকর্ষণ করেছিল ঢাকার সর্বস্তরের সর্বশ্রেণির গণমানুষকে।

সাঈদ হায়দার: চিকিৎসক। একুশের চেতনা পরিষদের সহসভাপতি ও প্রথম শহীদ মিনারের অন্যতম সহযোগী নকশাবিদ।

লেখকের পিছু ফিরে দেখা (প্রকাশিকা শরিফা হায়দার, ১৯৯৬) গ্রন্থ থেকে