প্রবাসীরা ডাকলেই সাড়া দিচ্ছে 'প্রবাসী হেল্পলাইন'

১১ এপ্রিল মধ্যরাত। ব্রাজিলের সাও পাওলো থেকে একটি বার্তা এল। ৩০ বছরের তরুণ প্রবাসী জানান, ছয়-সাত দিন ধরে ভুগছেন কাশি আর শ্বাসকষ্টে। ভাষা জানা না জানায় দেশটির টেলিমেডিসিন সেবা নিতে পারছেন না। তাঁকে সেবা দিতে ঢাকা থেকে তাঁর সঙ্গে যুক্ত হলেন চিকিৎসক, দিলেন পরামর্শ। আর পুরো কাজটা করে দিল স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘প্রবাসী হেল্পলাইন’।

দুনিয়াজুড়ে বিদ্যমান এই করোনা সংকটে প্রবাসী বাংলাদেশি মানুষকে নানাভাবে সহায়তা করে যাচ্ছে এই প্রতিষ্ঠান।

সৌদি আরবের জেদ্দা থেকে দাম্মাম যাচ্ছিলেন আট প্রবাসী শ্রমিক। পথে দেড় সপ্তাহ ধরে আটকে ছিলনে রিয়াদের পান্ডা মার্কেট এলাকায়। সঙ্গে আরও আট নেপালি শ্রমিক। টাকাপয়সা ফুরিয়েছে। খাবার কেনা বা ভাড়া দেওয়ার আর কোনো উপায় না পেয়ে ফোন করলেন। বাংলাদেশ দূতাবাস এগিয়ে গেল সহায়তায়।

মালয়েশিয়ার কেমপং থেকে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করলেন এক প্রবাসী। তাঁর চাচাতো ভাই মারা গেছেন রাতে। লাশ দেশে আনার বিষয়ে কিছু করা সম্ভব? যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনের রাজধানী সানা থেকে এক প্রকৌশলী জানতে চাইলেন, দেশে মায়ের চিকিৎসার টাকা পাঠাতে চান। কীভাবে পাঠাতে পারবেন?

ওমান থেকে এক প্রবাসী বাংলাদেশি ফোন করে বললেন, ১৩ জন একসঙ্গে থাকেন। তাঁদের মেসের খাবার শেষ। একজনের জ্বর আর কাশি। কোনো কিছু করা যাবে? আরেক বাংলাদেশি ইরাকের কুর্দিস্তান থেকে মেসেজ পাঠিয়ে জানতে চাইলেন, কীভাবে দেশে ফিরবেন?

এভাবে বাইরাইন, মালাক্কা, ইন্দোনেশিয়া, দুবাই, সৌদি আরব, পর্তুগাল, সিঙ্গাপুর, ইরাক, মালদ্বীপ, ইতালি থেকে মেসেজ বা কল আসছে প্রতিদিন। কারও কাশির সমস্যা, কারওবা জ্বর। চাকরি নেই, বেতন পাচ্ছেন না, বাড়ি ভাড়া দিতে পারছেন না, না খেয়ে আছেন, বাড়ি ফিরে আসতে চান—এমন নানা সমস্যা নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যোগাযোগ করছেন করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত প্রবাসীরা। তাঁদের ভরসার জায়গা প্রবাসী হেল্পলাইন। দিনরাত প্রবাসীদের কষ্ট, অনুযোগ শুনে সহায়তার চেষ্টা করে যাচ্ছে এ হেল্পলাইন। ঢাকা থেকেই ফোনে যুক্ত করে দিচ্ছে চিকিৎসককে। প্রয়োজনে দূতাবাস ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানাচ্ছে প্রবাসীর বিপদের কথা। আবার প্রবাসীকে দিচ্ছে জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগের নম্বর ও পরামর্শ। করোনাকালে লাখো প্রবাসী নানা সংকটে দিন কাটাচ্ছেন।

প্রবাসীদের পাশে দাঁড়াতে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রবাসী হেল্পলাইন যাত্রা শুরু করে গত ২৯ মার্চ। গতকাল পর্যন্ত এটি পৌঁছেছে ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি বাংলাদেশির কাছে। এ সময়ে প্রবাসী হেল্পলাইন নামের ফেসবুক পেজে মেসেজ পাঠিয়ে সাহায্য চেয়েছেন প্রায় ২০ হাজার প্রবাসী। আর ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সাহায্য খুঁজেছেনে ২৪ হাজার মানুষ। প্রবাসী মানুষগুলোর প্রশ্নের উত্তর দেওয়া, তাঁদের চিকিৎসক আর কাউন্সেলরের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া, ফলোআপ কল করে বা মেসেজ পাঠিয়ে আপডেট জানানো, খোঁজখবর নেওয়ার কাজটি করে যাচ্ছেন প্রবাসী হেল্পলাইনের স্বেচ্ছাসেবীরা। এটিই এখন কয়েকজন চিকিৎসক, মনঃসামাজিক কাউন্সেলর আর স্বেচ্ছাকর্মীদের রোজনামচা। এ সংগঠনটি বলছে, প্রবাসী হেল্পলাইনের ওয়েবপেজে করোনা–সংক্রান্ত তথ্য ও পরামর্শের পাশাপাশি কোনো দেশের নাম লিখলে সঙ্গে সঙ্গে সেই দেশের করোনা হটলাইন/হেল্পলাইন নম্বর যেমন পাওয়া যাবে, তেমনি সেই দেশে বাংলাদেশের দূতাবাস বা মিশন থাকলে তারও নম্বর ও ঠিকানা পাওয়া যাবে।

প্রবাসী হেল্পলাইন বলছে, শুধু একবার পরামর্শ দিয়েই থেমে থাকে না প্রবাসী হেল্পলাইন। এরপরও নিয়মিত খোঁজ রাখে ওই প্রবাসীর। প্রবাসীরাও নিজ থেকে তাঁদের আপডেট জানান। যেমন জানিয়েছেন সাও পাওলোর তরুণটি। ঢাকার চিকিৎসক ঝুঁকি না নিয়ে তাঁকে করোনার পরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু তরুণটি নিরুপায়। তাই প্রবাসী হেল্পলাইন থেকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করোনা সেলের সমন্বয়ক ও অতিরিক্ত সচিব খলিল রহমানকে জানানো হয় বিষয়টি। দুদিন পর ব্রাজিলপ্রবাসী নিজেই জানান, তাঁর কোভিড টেস্ট নেগেটিভ এসেছে, সহায়তা পেয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। আবার খাদ্যসহায়তা পেয়ে ছবি তুলে পাঠান প্রবাসীরা।

জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মুঈদ, প্রযুক্তি ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ রিদওয়ান হাফিজ ও কাজল আবদুল্লাহ মিলে তৈরি করেছেন প্রবাসী হেল্পলাইন। তরুণ এ তিন উদ্যোক্তার কাজে কারিগরি সহযোগিতা দিচ্ছে অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সি গো জায়ান, ডেটা প্রতিষ্ঠান অ্যানালাইজেন, অভ্যন্তরীণ রুটে পণ্যবাহী নৌযান ভাড়ার প্রতিষ্ঠান জাহাজি।

এ বিষয়ে আবদুল্লাহ আল মুঈদ প্রথম আলোকে বলেন, করোনাকালে প্রবাসীদের পাশে দাঁড়ানোর ভাবনা থেকেই প্রবাসী হেল্পলাইন ও প্রবাসীদের জন্য টেলিমেডিসিন সেবার সূচনা। তবে যেসব প্রবাসী করোনার সময় দেশে ফিরেছেন বা ভবিষ্যতে দেশে ফিরবেন বা বিদেশে যাবেন, প্রবাসী হেল্পলাইন তাঁদেরও তথ্য ও টেলিমেডিসিন পরামর্শ সেবা দেবে বিনা মূল্যে।

প্রবাসীদের টেলিমেডিসিন সহায়তা দিতে ক্লিক এন কেয়ার, টনিক, ডাক্তারভাই, মায়া, পালস, আলয়েল আর ডাক্তার দেখাও-এর মতো প্রতিষ্ঠানের কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছে প্রবাসী হেল্পলাইন। এপ্রিলের শুরু থেকে একযোগে কাজ করছে এ আটটি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের সহায়তার বিষয়ে প্রবাসীদের জানাতে বিভিন্ন মিশনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তিও প্রচার করেছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

টেলিমেডিসিন সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি প্রবাসী হেল্পলাইন বাংলাদেশ সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ সহায়তা পেয়েছে বলে জানান আবদুল্লাহ আল মুঈদ। তিনি বলেন, মহামারি পরিস্থিতিতে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের জন্য সাধারণ-জরুরি চিকিৎসা পাওয়াও হয়ে উঠেছে কঠিন। এই সমস্যার সমাধান হিসেবে এসেছে টেলিমেডিসিন।

সব প্রবাসীর সুবিধার জন্য ওয়েবসাইটে ব্যবহার করা হয়েছে বাংলা ভাষা। প্রবাসীদের বিনা মূল্যে টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা পাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে এ সংগঠন। এ বিষয়ে প্রবাসী হেল্পলাইনের সহযোগী প্রতিষ্ঠাতা কাজল আবদুল্লাহ বলেন, ‘ফেসবুকে আমাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করামাত্র প্রবাসী হেল্পলাইনের চিকিৎসকেরা হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলছেন প্রবাসীদের সঙ্গে, বিনা মূল্যে।’
প্রবাসী হেল্পলাইনে যোগাযোগের ঠিকানা: (https://www.facebook.com/probashihelpline/) (www.probashihelpline.com)