প্রাতিষ্ঠানিক স্বাভাবিক প্রসব কমেছে ১৬%

দেশে প্রাতিষ্ঠানিক স্বাভাবিক প্রসবের যে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে, করোনাকালে তা আরও বেড়েছে।

সূত্র: বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) ২০১৭-১৮

রাজধানীতে বাস করলেও গর্ভধারণের পর একবারও হাসপাতালে গিয়ে সেবা নেননি নার্গিস আক্তার (২৫)। গত ১২ অক্টোবর ভাড়া বাসাতেই সন্তান হয় তাঁর। প্রতিবেশী এক নারী সন্তানের নাড়ি কাটেন। ভাটারা থানার কুড়াতলী পূর্বপাড়ার বাসিন্দা নার্গিসের স্বামী রিকশাচালক। হাসপাতালে না যাওয়ার কারণ হিসেবে প্রথম আলোকে তিনি বললেন, ‘হাসপাতালে গেলেই টাকা লাগে। আমার তিন বাচ্চাই বাসায় নরমালে (স্বাভাবিক প্রসব) হয়েছে।’

একই ভাড়া বাসায় নার্গিসের পাশের কক্ষে থাকেন তাঁর ছোট বোন নাসিমা আক্তার (২০)। গত বছরের ডিসেম্বরে বাসাতেই চাচির হাতে তাঁর প্রথম সন্তান প্রসব হয়। তবে প্রসবের আগে তিনি দুবার চিকিৎসক দেখিয়েছিলেন। নাসিমা জানালেন, আলট্রাসনোগ্রাম করানো, আয়রন ও ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট কেনা ইত্যাদিতে বেশ কিছু অর্থ খরচ হয়। এ কারণে আর হাসপাতালে যাননি।

সরকারি তথ্য বলছে, দেশে প্রাতিষ্ঠানিক স্বাভাবিক প্রসবের যে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে, করোনাকালে তা আরও বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরাও মনে করছেন, করোনাকাল অন্তঃসত্ত্বা নারীদের সেবাপ্রতিষ্ঠানে এনে নিরাপদ স্বাভাবিক প্রসব বাড়ানোর লক্ষ্যকে আরও চ্যালেঞ্জে ফেলেছে। তাঁরা বলছেন, মা ও নবজাতকের জীবন রক্ষায়, মৃত সন্তান জন্ম কমাতে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবসেবা শতভাগ করতেই হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পরামর্শ, একটি দেশের প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব ৮৫ শতাংশ হওয়া উচিত। সংস্থাটির মতে, অস্ত্রোপচারে শিশু জন্ম ১৫ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়। এ হার ৫ শতাংশের নিচে রাখার পক্ষে তারা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা হাসপাতাল ও সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে মোট সন্তান প্রসব ১৮ শতাংশ এবং স্বাভাবিক প্রসব ১৬ শতাংশ কম হয়েছে। আর পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ৩ হাজার ৩৬৪টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র এবং ২৫৫টি মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্রে (ইউনিয়নে ১৮৩টি, উপজেলায় ১২টি ও জেলায় ৬০টি) মোট প্রসব প্রায় ৯ শতাংশ এবং স্বাভাবিক প্রসব প্রায় ৭ শতাংশ কম হয়েছে। গত চার বছরের মধ্যে এ হার সর্বনিম্ন।

বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) ২০১৭-১৮ প্রতিবেদন অনুসারে, বছরে প্রতি হাজারে ২১.৯টি শিশু জন্ম নেয়। জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯১ লাখ হিসাবে বছরে জন্ম নিচ্ছে ৩৭ লাখের বেশি শিশু। এর মধ্যে ৫০ শতাংশ বাড়িতে প্রসব হয়। বাকি ৫০ শতাংশের প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব হয়। প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের দুই-তৃতীয়াংশ বেসরকারি সেবাপ্রতিষ্ঠানে হলেও সেখানে অস্ত্রোপচারে শিশু জন্মের হার অতি উচ্চ, ৮৬ শতাংশ। সরকারি সেবাপ্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক প্রসব তুলনামূলক অনেকটাই বেশি, ৬৪ শতাংশ। তবে প্রয়োজনের তুলনায় সরকারি সেবাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনেক কম। এ ছাড়া ২৪ ঘণ্টা সেবাও পাওয়া যায় না সেখানে।

মাতৃস্বাস্থ্য নিয়ে মাঠপর্যায়ের কাজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে সেভ দ্য চিলড্রেনের কর্মকর্তা ইশতিয়াক মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, বাড়ির কাছে অর্থাৎ ইউনিয়ন পর্যায়ে জনবল ঘাটতি পূরণ করে এবং প্রশিক্ষিত ধাত্রী রেখে সপ্তাহের সাত দিনই ২৪ ঘণ্টা সেবা বাড়াতে না পারলে প্রাতিষ্ঠানিক স্বাভাবিক প্রসব বাড়ানো সম্ভব হবে না। ভালো সেবা দিলে দুর্গম এলাকার মায়েরাও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসে সেবা নেন বলে নজির রয়েছে।

করোনাকালে মাতৃ স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হওয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব কম হয়েছে উল্লেখ করে ইশতিয়াক মান্নান বলেন, করোনাকালে সেবা ব্যাহত হওয়ার কারণগুলো ভালোভাবে বিশ্লেষণ করে চ্যালেঞ্জগুলোকে শনাক্ত করে পরিকল্পনাগুলোকে নতুন করে সাজাতে হবে।

স্বাভাবিক প্রসব কমেছে, রয়েছে উল্টো চিত্রও

রাজধানী জুরাইনের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী সাদিয়া আক্তার গত ১৪ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্বাভাবিক প্রসবে তৃতীয় সন্তানের জন্ম দেন। হাসপাতালে আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর স্ত্রীকে লেবার রুমে নিতে দেরি করায় হাসপাতালের ট্রলিতেই সন্তান জন্ম হয়।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তথ্য অনুসারে, সেখানে ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে প্রসবসেবা ৩৭ শতাংশ কমেছে এবং স্বাভাবিক প্রসব কমেছে ৪৫ শতাংশ।

গত ১২ অক্টোবর সকাল সাড়ে নয়টায় মিরপুরের লালকুঠি ২০০ শয্যাবিশিষ্ট মাতৃ ও শিশু হাসপাতাল এবং মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে চেয়ারে বসে অপেক্ষা করছিলেন শাহিদা বেগম, সূর্যভান ও রাশিদা। আগের দিন ১১ অক্টোবর তাঁদের মধ্যে প্রথম দুজনের মেয়ে এবং তৃতীয়জনের পুত্রবধূ অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিয়েছেন। হাসপাতালের তথ্য অনুসারে, সেখানে ১১ অক্টোবর হওয়া ৪টি প্রসবের সব কটিই অস্ত্রোপচারে হয়েছে। এর আগপর্যন্ত হাসপাতালটিতে সবশেষ ৩০ সেপ্টেম্বর এক মায়ের স্বাভাবিক প্রসব হয়েছিল।

এর উল্টো চিত্র পাওয়া গেল রাজধানীর মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার এবং ১০০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশু হাসপাতালে। ১২ অক্টোবর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সেখানে কথা হয় স্বপ্না আক্তার নামের এক মায়ের সঙ্গে। প্রসব-পরবর্তী পর্যবেক্ষণ কক্ষে ঘণ্টা চারেক আগে জন্ম নেওয়া মেয়েকে কাপড়ে মুড়িয়ে নিয়ে পাশে শুয়ে ছিলেন। জানালেন, ১১ অক্টোবর দুপুরে প্রসববেদনা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তির পর তাঁকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয় এবং পরদিন (১২ অক্টোবর) সকাল সাতটায় নার্স ও আয়ার হাতে স্বাভাবিক প্রসবের মাধ্যমে তাঁর সন্তানের জন্ম হয়।

মাইশা নুহাশ নামে এক নারী প্রসব কক্ষের বাইরের করিডরে হাঁটাহাঁটি করছিলেন। জানালেন, আগের দিন অল্প ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

সরকারি এই সেবাপ্রতিষ্ঠানে ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে প্রসব বেড়েছে ১০ শতাংশ, স্বাভাবিক প্রসব বেড়েছে ২৬ শতাংশ এবং অস্ত্রোপচারে শিশুজন্ম কমেছে ৬ শতাংশ। হাসপাতালের পরিচালক মো. মুনীরুজ্জামান সিদ্দীকী প্রথম আলোকে বলেন, করোনাকালের শুরুতে যখন বড় সরকারি হাসপাতাল এবং সব বেসরকারি হাসপাতাল অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের ফিরিয়ে দিচ্ছিল, তখনো এখানে এক দিনের জন্যও সেবা বন্ধ ছিল না। এখানে মায়ের শারীরিক অবস্থা ও গর্ভের শিশুর অবস্থান বুঝে স্বাভাবিক প্রসবের ওপর জোর দেওয়া হয় বলে জানান তিনি।

বাড়ির কাছে স্বাস্থ্যকেন্দ্র, তবে ‘সেবা নেই’

এ বছরের শুরুতে বাড়িতে ছেলেসন্তানের জন্ম দিয়েছেন কমলা খাতুন। নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার হোগলা ইউনিয়নের মহেষপট্টি গ্রামের এই নারীর বাড়ি থেকে স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দূরত্ব মাত্র দুই কিলোমিটার। দরিদ্র পরিবারের এই গৃহবধূ প্রথম আলোকে মুঠোফোনে বলেন, হাসপাতালে গেলে অস্ত্রোপচার হতে পারে, যাতায়াতের জন্য ভাড়া লাগবে, ওষুধপথ্য কিনতে হতে পারে—এসব চিন্তায় যাননি। তাঁর বাবার বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ির সব নারীর বাড়িতেই সন্তান প্রসব হয়।

বাড়ির কাছে সেবা প্রতিষ্ঠান থাকলেও সেখানে কমলারা যান না কেন জানতে চাইলে হোগলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম আকন্দ প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকলেও সেখানে কোনো চিকিৎসক নেই। তিন বছর আগে বহু দেনদরবার করে একজন চিকিৎসকে আনা গিয়েছিল, কিন্তু তিনি দুই মাস কাজ করে চলে যান। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একজন করে উপসহকারী কমিউনিটি চিকিৎসা কর্মকর্তা (স্যাকমো) এবং পরিবারকল্যাণ পরিদর্শক (এফডব্লিউভি) থাকলেও তাঁরা নিয়মিত নন। কোনো অন্তঃসত্ত্বা নারীকে সেবা নিতে হলে পূর্বধলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে হয়।

প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবে জোর দিচ্ছে সরকার

সেবা ভালো হলে অন্তঃসত্ত্বা নারীরা হাসপাতালে যেতে আগ্রহী হন, তার উদাহরণ গাইবান্ধার মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র। প্রাতিষ্ঠানিক স্বাভাবিক প্রসবে সাফল্যের কারণে প্রতিষ্ঠানটি ১১ বার জাতীয় এবং একবার বিভাগীয় পুরস্কার পেয়েছে।

এ প্রসঙ্গে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা) মোহাম্মদ শরীফ প্রথম আলোকে বলেন, সব সেবা প্রতিষ্ঠানে একই রকম সেবা নিশ্চিত করা যায়নি। দেশের ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে এক হাজার তিন শর মতো স্যাকমো এবং দেড় হাজারের মতো পরিবারকল্যাণ পরিদর্শক নেই। এ কারণে সেবা বিঘ্নিত হয়। ধাপে ধাপে এসব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। শিগগিরই ১ হাজার ৮০ জন এফডব্লিউভি নেওয়ার জন্য নিয়োগ পরীক্ষা হবে।

মোহাম্মদ শরীফ বলেন, সরকার এখন প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবে জোর দিচ্ছে। একে ১০০ শতাংশে নিতে চায়। ডব্লিউএইচওর পরামর্শ অনুসারে প্রাতিষ্ঠানিক স্বাভাবিক প্রসব ৮৫ শতাংশের মধ্যে চায় সরকার। এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট সময়সীমা না থাকলেও সরকার দ্রুত এ লক্ষ্যে পৌঁছাতে কাজ করছে।

সরকারি সেবা বাড়াতে হবে

বিডিএইচএসের তথ্য অনুসারে, ২০০৭ থেকে ২০১৭—এই ১১ বছরে প্রসবসেবা বেসরকারি সেবাপ্রতিষ্ঠানগুলাতে ২২ থেকে বেড়ে ৩২ শতাংশ হয়েছে। আর সরকারি সেবাপ্রতিষ্ঠানে তা মাত্র ১ শতাংশ বেড়ে ১৪ শতাংশ হয়েছে।

স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যায় বিশেষজ্ঞ-চিকিৎসকদের সংগঠন অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগম প্রথম আলোকে বলেন, মা ও নবজাতকের জীবন রক্ষায়, মৃত জন্ম কমাতে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবসেবা শতভাগ করতেই হবে। দারিদ্র্যের কারণে অনেক মায়ের প্রসবসেবা বাড়িতে অগ্রাধিকার পায় না। প্রসবের সময় বাড়ি থেকে রওনা দিতে দেরি করা, যাতায়াতের সমস্যায় দেরি হওয়া এবং হাসপাতালে আসার পর চিকিৎসায় দেরি হওয়া—এই তিন কারণে অন্তঃসত্ত্বা নারীর জীবন ঝুঁকিতে পড়ে যায়। এ কারণগুলো বিবেচনায় রেখে সরকারি সেবা বাড়াতে হবে।