প্রামাণ্য নজরুল-জীবনী

গোলাম মুরশিদ

মাইকেল মধুসূদন দত্তকে নিয়ে আজ থেকে ২৫ বছর আগে বিশিষ্ট গবেষক গোলাম মুরশিদের ‘আশার ছলনে ভুলি’ বইটি প্রকাশের পর বাংলা জীবনীমূলক সাহিত্যের এক নতুন অভিমুখ নির্মিত হয় বলা চলে৷ জনশ্রুতি, গালগল্প, অপ্রমাণিত অথচ লোকরঞ্জক উপাদানের আবিল অজস্রতার বিপরীতে তিনি প্রামাণ্য মধুসূদনকে পাঠকের সামনে উপস্থিত করে অন্য বঙ্গীয় মনীষাদের এমন জীবনীর প্রতি আমাদের করেছেন অপার আগ্রহী। তাঁর শ্রম, মেধা ও মনীষার ফলাফল হিসেবে ২০১৮-তে প্রকাশ পেয়েছে ‘বিদ্রোহী রণক্লান্ত: নজরুল-জীবনী’ (প্রথমা প্রকাশন, সম্প্রতি বইটি আইএফআইসি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত )।


বইয়ের ভূমিকায় তিনি স্পষ্ট করেছেন নতুন এই নজরুল-জীবনীর অন্বিষ্ট-

‘তাঁর যেসব “জীবনী” লেখা হয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগই বীরপূজামূলক এবং অতিরঞ্জিত।...আমি তাই এইসব বইপত্রের তথ্যাদি যাচাই-বাছাই করে ব্যবহার করেছি৷ তা ছাড়া, আমি তাঁকে দেখেছি সদা-পরিবর্তনশীল এক প্রতিভা হিসেবে। সেই সঙ্গে মনে রেখেছি যে তিনি সীমাবদ্ধতাপূর্ণ একজন রক্তমাংসের মানুষ ছিলেন।’


অতিমানব নয়; মানুষ নজরুলকে আবিষ্কারের প্রয়াসে পাঁচ শতাধিক পৃষ্ঠার এই নজরুল-জীবনীতে পরিস্ফুট যে মানুষ-সুন্দরের গানই ছিল নজরুলের মৌল সৃষ্টিসুর।


‘জন্ম, পরিবার ও পরিবেশ’, ‘হাবিলদারের বিদ্রোহ’, ‘ক্ষণিকের ধূমকেতু, চিরদিনের আশা(লতা)’, ‘ঘর বাঁধার পথে’, ‘রাজনীতির চোরাবালিতে’, ‘রণক্লান্ত’, ‘স্বপ্ন ও বাস্তবতা’, ‘স্বেচ্ছানির্বাসন’, ‘আধ্যাত্মিকতার পথে’, ‘নীরব কবি!’— এমন ১০টি পর্বের ক্রমিক পরম্পরায় বিচিত্র, বর্ণিল, ব্যতিক্রম নজরুল-জীবনকে মালার মতো গেঁথেছেন গোলাম মুরশিদ।

নজরুলের জন্ম, পটভূমি, পরিবার নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি প্রচলিত সব তথ্যপঞ্জি ও স্মৃতিলেখার পুনর্পাঠই শুধু করেননি, একই সঙ্গে কবির আবির্ভাব ও প্রাথমিক বিকাশের সঙ্গে যুক্ত অঞ্চল, যেমন বর্ধমান, আসানসোল, রানীগঞ্জ, শিয়ারশোলের বিশদ বিবরণ এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন, তা পাঠকের সামনে ছবির মতো ধরা দেয় নজরুলের পরিবেশ-প্রতিবেশ। আবার নজরুলকে বিশদ বুঝতে গিয়ে নজরুল-সম্পৃক্তজনদের প্রামাণ্য উপস্থিতিও দেখতে পাই। মাথরুন স্কুল ও শিয়ারশোল রাজ স্কুলের ছাত্র নজরুল নিয়ে আলোচনা-প্রসঙ্গে কুমুদরঞ্জন মল্লিক বা শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের কথা এসেছে বলিষ্ঠ সূত্র হয়ে। প্রথম মহাযুদ্ধের বাঙালি পল্টনে নজরুলের যোগদানের পুরো চিত্রটির তথ্য স্বচ্ছ করার স্বার্থে লেখক বেঙ্গল ডাবল কোম্পানি বা ৪৯-তম বেঙ্গলিজ-এর রংরুট হয়ে করাচির পথে কলকাতা ত্যাগকারীদের নামের তালিকায় নজরুলের ভুক্তি দেখতে তিনি ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে রক্ষিত ‘বেঙ্গলি’ পত্রিকায় ১৯১৬-১৮ কালপর্বে প্রকাশিত শ পাঁচেক নাম যাচাই করার শ্রম স্বীকার করেছেন। করাচি-কালীন নজরুলকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মুরশিদ পরিচিত কথার পুনরাবৃত্তি করে দায়িত্ব সারেননি বরং নজরুলের সহকর্মীর আবেগপ্রধান অথচ নির্বিচারে বহুব্যবহৃত কথা খণ্ডন করেছেন। ১৯১৭ সালের অক্টোবরে রুশ বিপ্লবের খবর ১৯১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে নজরুল জানতে পারেন—এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার আগে তিনি শম্ভু রায়ের তথ্য বিচার করে দেখেন ঋতুচক্র হিসাব করে—

বিদ্রোহী রণক্লান্ত: নজরুল–জীবনী গোলাম মুরশিদ।
প্রথমা প্রকাশন

‘শম্ভু রায়ের বক্তব্য ছিল অতিরঞ্জিত। নজরুল কখন বলশেভিক বিপ্লবের খবর পেয়েছিলেন, সে সম্পর্কে তাঁর উক্তি বিভ্রান্তিকর। কারণ তিনি প্রথমে বলেছেন, বছরের শেষ দিকে। তারপর বলেছেন, শীতের শেষ দিকে। বছরের শেষ দিকে—নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে শীত কমে আসে না, বাড়তে থাকে। শীত কমে আসে ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে।’

নজরুলের নামে পূর্বে পরিবেশিত এমন বিপুল ভ্রান্ত তথ্যের যুক্তিপূর্ণ অপনোদন ‘বিদ্রোহী রণক্লান্ত’-এর মর্যাদা বাড়িয়েছে।
‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনার পূর্বাপর আলোচনা করতে গিয়ে তৎকালীন নজরুল-মানস বুঝতে তিনি নজরুলের হাতে লেখা ১৯২৬-এর পরিকল্পিত পাঠতালিকাও সামনে রাখেন, যার মাধ্যমে বুঝতে পারা যায় ১৯২১-এর ডিসেম্বরে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লেখার আগে কার্ল মার্ক্সের ‘ক্যাপিটাল’ পড়ার অনুমান অভ্রান্ত নয়। আবার একটি কালোত্তীর্ণ কবিতার জন্মের নেপথ্যে সেই কবির মানস-বিবর্তনের ধাপগুচ্ছ কবিতা থেকে কবিতায় শব্দের ইঙ্গিতবহ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে ধরতে চেয়েছেন—


‘সেপ্টেম্বর মাসে (১৯২১) “আগমনী”তে যে-অর্থে “মানব” কথাটা লিখেছিলেন, ডিসেম্বরের শেষ অবধি সেখান থেকে তিনি লক্ষণীয় মাত্রায় সরে এসেছিলেন। এই তিন মাসের মধ্যে তাঁর মননে “মানবতা” কথাটার খানিকটা বিবর্তন লক্ষ করি৷ “আগমনী” কবিতায় যখন লিখেছিলেন, তিনি “সুর-অসুর” চান না, তিনি চান “মানব”; যদিও তখন তাঁর কাছে সেই “মানব”-এর ধারণা ছিল নীহারিকাবৎ, যা তখনো সুস্পষ্ট আকার ধারণ করেনি। ডিসেম্বরের শেষে তিনি যখন “বিদ্রোহী” কবিতা রচনা করেন, তখন সেই অবয়বহীন “মানব”ই “উৎপীড়িত মানুষে”র মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করে।’

বিদ্রোহীর পাশাপাশি প্রেমিক নজরুলকে সন্ধান করেছেন লেখক; কুমিল্লায়, ঢাকায়, দার্জিলিংয়ে—নার্গিস, প্রমীলা, ফজিলতুন্নেসা, উমা মৈত্র, কিংবা জাহানারা বেগম চৌধুরীকে তিনি নজরুল-সাপেক্ষে বিচার করেননি। তাঁদের নিজস্বতাও গবেষকের অনুসন্ধানী দৃষ্টিভুক্ত। নজরুল-প্রমীলার বিবাহ অনুষ্ঠানের স্থান কলকাতার ৬ নম্বর হাজী লেনের নামটি পরিবেশন করাকেই তিনি যথেষ্ট মনে না করে বৈরী বাস্তবতা অনুধাবনে আনতে সে এলাকার সচিত্র বিবরণ দিয়েছেন৷ অস্থির-উদ্দাম নজরুলের কবিতা, বই ও গানের রচনা, প্রকাশ ও রয়্যালটির যথাসম্ভব তথ্য সমাবেশের সমান্তরালে অনুপস্থিত নয় কলকাতা থেকে কৃষ্ণনগর পর্যন্ত কবির প্রতিটি আবাসের অনুপুঙ্খ বিবরণ। তাঁর সম্পাদিত পত্রপত্রিকার চারিত্র্য স্পষ্ট করতে এদের পৃষ্ঠপোষক, বিজ্ঞাপনদাতা, লেখক, সার্কুলেশন, সমকালীন প্রভাব খতিয়ে দেখেছেন জীবনীকার৷ এক রাজনৈতিক নির্বাচনের প্রার্থী নজরুলের ভোটের ফলাফল দিতে গিয়ে লেখক যখন ভোটের চোরাবালিতে কবির পর্যুদস্ত অবস্থার সঙ্গে তাঁর বইয়ের অনুষঙ্গ যুক্ত করেন, তখন তা তথ্যের শুষ্কতার অধিক পাঠ-উপভোগ্য হয়ে ওঠে—


‘অতগুলো বই বাজেয়াপ্ত হয়েছিল যাঁর, সেই বাজেয়াপ্ত-অভিজ্ঞ কবিও কল্পনা করতে পারেননি যে তাঁর জামানত বাজেয়াপ্ত হতে পারে।’
গণমানুষের নজরুলপ্রীতির বিপরীতে নজরুল-বিরোধিতার স্বরূপ-সন্ধান করতে গিয়ে তিনি ১৯২৯ সালে তাঁকে জ্ঞাপনকৃত জাতীয় সংবর্ধনা ঘিরে নেতিবাচক আলোচনাগুলোও এড়িয়ে যাননি। আবার এই তথ্যও দিতে ভোলেননি যে নজরুল-রসায়ন এমনই তীব্র ছিল যে বিরোধিতাকারী এক বিশিষ্টজনও শেষ পর্যন্ত নজরুল-সংবর্ধনা কমিটির নির্বাহী সদস্য হন। দফায় দফায় কারারুদ্ধ নজরুলের মামলার নথি, পত্রিকায় প্রকাশিত কবির আদালতে হাজিরা, শুনানি, সাক্ষ্য, জামিন, রায়—সবকিছুর বিবরণও জড়ো করেছেন লেখক৷ গ্রামোফোন কোম্পানিতে নজরুলের যুক্ততাকে তিনি নতুন আলোয় নিয়ে এসেছেন—


‘গ্রামোফোন কোম্পানিতে নজরুলের কাজ নিয়ে তাঁর জীবনীলেখকেরা ঢালাও মন্তব্য করেছেন। এর ফলে একটা জনপ্রিয় ধারণা জন্মেছে যে নজরুল গ্রামোফোন কোম্পানিতে চাকরি করতেন। কিন্তু গ্রামোফোন কোম্পানিতে তাঁর বাঁধা আয়ের কোনো চাকরি ছিল না।...তাঁর কাজ বিভক্ত ছিল তিন ভাগে—গান লেখা, সেই গানে সুর দেওয়া এবং সেই সুর গায়ক-গায়িকাদের শিখিয়ে দেওয়া।’
গানের নজরুলের সঙ্গে নাটক ও চলচ্চিত্রের নজরুলও অনালোচিত থাকেন না এখানে; বিস্তর তথ্য-উপাত্তসমেত অঙ্কিত হয়েছে আধ্যাত্মিক রূপান্তরের পটচিত্র।

যাঁর বাণীতে মুখর ছিল তাঁর সমাজ ও স্বদেশ, সেই নজরুলের নীরব-অধ্যায়ের ট্র্যাজিক আলেখ্য পাওয়া যায় বইয়ের শেষ পর্বে। নজরুলের অসুস্থতা, তাঁর সাহায্যার্থে গঠিত নিরাময় সমিতি, চিকিৎসা-প্রচেষ্টার কৌতুহলোদ্দীপক বর্ণনা পাই আমরা এখানে৷ ‘নজরুল সাহায্য কমিটি’, ‘নজরুল এইড ফান্ড’ থেকে শুরু করে নজরুলের সহায়তায় লটারি খেলা আয়োজনের তথ্য প্রদানপূর্বক লেখকের সত্যসন্ধ সিদ্ধান্ত—
‘অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে সাহায্য পাওয়ার ব্যাপারে নজরুলের ভাগ্য তাঁকে খুব একটা আনুকূল্য করেনি।’
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নজরুলকে বাংলাদেশে আনয়ন ও তাঁর জীবনাবসান পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহের সংক্ষিপ্ত রেখাচিত্রে এই জীবনী সমাপ্ত করেছেন লেখক। তবে গোলাম মুরশিদের ‘বিদ্রোহী রণক্লান্ত’ পাঠ শেষে পাঠকের সঙ্গে প্রকৃতপক্ষে দেখা হয় সেই প্রামাণ্য নজরুলের, যিনি অশেষ ও অফুরান।