প্রেমে ব্যর্থ শুভ এখন মানুষকে ভালোবাসেন, রোগীদের পাশে দাঁড়ান

হারানো রোগীদের স্বজন খুঁজে দেন শুভ মজুমদার
ছবি: সংগৃহীত

বছর খানেক আগের কথা। অল পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপের পরিচালক মাহবুবা রহমান তাঁর এক স্বজনকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না। সেই স্বজন ক্রনিক সিজোফ্রেনিয়ার রোগী। আত্মীয়ের বাসা, হাসপাতাল, রেলস্টেশন—সব জায়গায় খোঁজাখুঁজি শেষ। সন্ধান পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে কেউ কেউ টাকা–পয়সা পর্যন্ত হাতিয়ে নিয়েছে। এমন একটা সময়ে মাহবুবার সেই স্বজনের খোঁজ দিলেন শুভ মজুমদার নামের এক ব্যক্তি।
মাহবুবা প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুভকেও প্রথমে ফ্রড (প্রতারক) ভেবেছিলাম আমরা।

ভুল বুঝেছিলাম। পরে জানলাম, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অচেনা রোগীদের অনেককে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে শুভ।’ ক্রনিক সিজোফ্রেনিয়ায় ভোগা মাহবুবার ওই আত্মীয় ছয়দিন ঢাকা মেডিকেলে ছিলেন। একটি কথাও বলেননি।

সেখানেই দেখা হয় শুভর সঙ্গে। সাত দিনের দিন শুভকে কী ভেবে যেন মঠবাড়িয়ায় তাঁর গ্রামের বাড়ির ঠিকানা বলেন মাহবুবার ওই স্বজন। ওই ঠিকানা নিয়ে ৯৯৯–এ ফোন করে আত্মীয়–স্বজনের খোঁজ পান শুভ। এরপরই তাঁকে পরিবারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।

শুভ কেন, কীভাবে এই কাজে জড়ালেন, সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে শুভ ও তাঁর বন্ধুদের খোঁজ পাওয়া গেল কী করে, তা-ই জানা যাক। গত ২৮ ডিসেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল আয়েশার ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া। শাহবাগ থানার কাছে আস্তাকুঁড়ে আয়েশাকে ছেড়ে গিয়েছিল পরিবারের লোকজন। সেখান থেকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায় পুলিশ। সেই থেকে ওখানেই আছে সে। তালুর সঙ্গে জিব আটকে থাকায় কথা বলতে পারত না। সেই জট খুলতে সম্প্রতি অস্ত্রোপচার হয়েছে।

আয়েশার সঙ্গে কথা বলার অনুমতি নিতে পরিচালকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে বাইরে অপেক্ষমাণ অবস্থায় পাওয়া যায় শুভকে। তিনিই পথ দেখিয়ে নিয়ে যান শিশুটির কাছে। জানা যায়, আয়েশা শুভকে ‘বাবা’ বলে ডাকে। ওই ওয়ার্ডের সেবাকর্মী লাইজু শুভকে জানান, আয়েশা আজকাল কথায় কথায় জেদ করে। কিছুক্ষণ আয়েশার সঙ্গে শুভর খুনসুটি চলে। এক ফাঁকে শিশু চিকিৎসক মো. কামাল হোসেন শুভর কাছে জানতে চান, আয়েশাকে পুনর্বাসনের কী হলো।

ওই দিনই শুভর সঙ্গে যাই নিউরোলজি বিভাগে। চারজন অপরিচিত রোগী ওখানে। সবাই অচেতন। একজন এসেছেন তখনই। এক পায়ে মোজা আছে, অন্যটি খালি, কানের পাশে রক্তের গাঢ় দাগ। বাকি দুজন গভীর ঘুমে। সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধের চোখ শুধু খোলা। ‘চাচা’ বলে ডাকতে অপলক তাকিয়ে থাকেন শুভ মজুমদারের দিকে। চেনার চেষ্টা করেন। পারেন না। এই ওয়ার্ডে শুভর বন্ধু আল আমিন নামের এক ওয়ার্ডবয়।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু আয়েশা। শুভকে ‘বাবা’ বলে ডাকে সে
ছবি: সংগৃহীত

তাঁরা রোগীদের দেখাশোনা করেন, ফাইল নিয়ে চিকিৎসকদের কাছে যান, প্রয়োজনীয় সেবার ব্যবস্থা করেন। হাসপাতাল ও পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। শুভ জানান, অচেনা রোগীদের প্রতি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সহানুভূতিশীল। তাঁদের বিনা মূল্যে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা দিতে কোনো দিন তাঁরা পিছপা হন না। পুলিশ-পথচারীরা ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। তিনি যে কাজটা করেন, তা হলো প্রতিদিন একবার হাসপাতালে এসে রোগীদের দেখে যান। আর পরিবারের খোঁজ করেন। অনেক রোগী এভাবে ফিরে গেছে পরিবারের কাছে।

সবশেষ কাকে ফিরিয়ে দিতে পেরেছেন পরিবারের কাছে? জানতে চাইলে আমিনুল ইসলামের নাম বলেন শুভ। কথা হয় তাঁর সঙ্গে। গত ১০ ডিসেম্বর আমিনুলকে মলম পার্টি ধরেছিল। গাজীপুর থেকে উত্তরা হাউস বিল্ডিংয়ে এসে বাস বদলেছিলেন ধানমন্ডির অফিসে যেতে। অফিসে আর পৌঁছাতে পারেননি। তিন দিন ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। শুভর সহায়তায় অফিসের সহকর্মী মোস্তফা কামাল তাঁকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে যান।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক কর্নেল মো. নাজমুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শুভ প্রায়ই আসেন অস্ত্রোপচার কিংবা অচেনা রোগীদের চিকিৎসার ব্যাপারে।

শুভকে কাজে সহায়তা করেন হাসপাতালের সেবাকর্মী আল আমিন
ছবি: সংগৃহীত

মধ্যপ্রাচ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে যুক্ত শুভ মজুমদার কীভাবে জড়ালেন এই কাজে? এমন প্রশ্নে তিনি বললেন, একটা সময় তিনি নিজেও অচেনা মানুষ হয়ে এসেছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। প্রায় ছয়-সাত বছর আগে। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে ১৫ দিনের ব্যবধানে দুবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। সেরে ওঠার পর আবারও ফিরে এসেছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

সে সময় জরুরি বিভাগে বাবার লাশের সামনে হতোদ্যম এক তরুণকে পেয়েছিলেন। কাছে যেতেই জড়িয়ে ধরে তিনি চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন। কীভাবে যেন তাঁর বাবার শেষযাত্রার সঙ্গী হয়ে যান শুভ। সিসিইউতে চাচার পাশে ছিলেন নড়াইলের এক তরুণ। পরদিন চাকরির সাক্ষাৎকার দিতে যেতে হবে তাঁকে। চাকরিটা দরকার, কিন্তু চাচার পাশে কে থাকবেন? শুভ থেকে যান একটানা সাত দিন। নারায়ণগঞ্জে এক বৃদ্ধা ছেলের সঙ্গে অভিমান করে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিলেন। তাঁর দেখাশোনার দায়িত্বও নেন শুভ। প্রায় আড়াই মাস পর নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা এক রোগীর স্বজন জানান, তিনি চেনেন বৃদ্ধাকে। ছেলে এসে মাকে নিয়ে যান। প্রায় চার মাস ছিলেন ৮০ বছরের এক বৃদ্ধার পাশে। টুকরো টুকরো এমন অনেক গল্প জমা হয়েছে শুভর ঝুলিতে। জীবনকে ভালোবেসে শুভ এই কাজটা করে যেতে চান।