প্রেসিডেন্টের বর্ণবাদী আচরণের চড়া মূল্য

হোয়াইট হাউস সম্প্রতি কিছু গোপন অডিও টেপ প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের বর্ণবাদী ও বিদ্বেষমূলক আচরণ কীভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি জান্তার পক্ষে সহায়ক হয়েছিল, তার কিছু প্রমাণ এসব টেপে আছে। টেপগুলো পর্যালোচনা করে ৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক টাইমস–এ মার্কিন অধ্যাপক গ্যারি জে ব্যাসের লেখা নিবন্ধ।

১৯৭১ সালে হোয়াইট হাউসে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডন্ট রিচার্ড নিক্সন
ছবি: নিউইয়র্ক টাইমস–এর সৌজন্যে

বর্ণবাদ ও ক্ষমতা—দুই সমস্যা মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রবাসী। এরই মধ্যে হোয়াইট হাউসের প্রকাশিত কিছু মূল্যবান নথিতে সাবেক প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের গোঁড়ামিপূর্ণ কথাবার্তার চমকপ্রদ তথ্যপ্রমাণ উঠে এসেছে।

নিক্সন সরকারের আমলে দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক মার্কিন নীতি কীভাবে ভারতীয়দের প্রতি তাঁর ঘৃণা ও যৌন বিতৃষ্ণায় প্রভাবিত হয়েছিল, তা জানা গেছে এসব নথি থেকে।

নতুন নথিগুলো শীতল যুদ্ধের নিষ্ঠুরতম উপাখ্যানগুলোরই একটির সঙ্গে সম্পর্কিত, যা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল। ওই সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে প্রবলভাবে ঝুঁকে পড়েছিল ভারত আর পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসক ছিল যুক্তরাষ্ট্রপন্থী। পাকিস্তানের ভূখণ্ডগত অবস্থান ছিল তখন ভারতের দুই পাশে। এক পাশে পশ্চিম পাকিস্তান আর অন্য পাশে দেশটির সবচেয়ে জনবহুল অংশ পূর্ব পাকিস্তান। আবার সেখানকার বাসিন্দাদের বেশির ভাগ ছিল বাঙালি।

পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা জয় লাভ করার পর ১৯৭১ সালের মার্চে জান্তা সরকার নিজ দেশের বাঙালি নাগরিকদের ওপর ভয়ংকর রক্তক্ষয়ী অভিযান শুরু করে।

নিক্সন ও কিসিঞ্জার পাকিস্তানের সামরিক সরকারকে প্রত্যক্ষ সমর্থন দেন। এই সরকার লাখ লাখ বাঙালিকে হত্যা করে এবং এক কোটি শরণার্থী পালিয়ে আশ্রয় নেয় ভারতে। নয়াদিল্লি গোপনে বাঙালি গেরিলাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দেয়। এই সংকটের চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৭১ সালে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের।

রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম ও এটি ঘিরে হোয়াইট হাউসের যে লজ্জাজনক কূটনীতি, তা তুলে ধরেছি ২০১৩ সালে প্রকাশিত আমার বই দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম-এ। তথ্যপ্রমাণের অনেকটা আমি নিয়েছি হোয়াইট হাউসের বেশ কিছু অডিও টেপ থেকে। এগুলো থেকে জানা যাচ্ছে, নিক্সন ও কিসিঞ্জার সত্যিই দরজার পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছিলেন। যদিও অনেক টেপের বড় বড় অংশ এখন পর্যন্ত অস্পষ্ট করা আছে।

এ–সংক্রান্ত টেপগুলোর সবটা কোনো রকম অস্পষ্টতা বা প্রতিবন্ধকতা ছাড়া উন্মুক্ত করার জন্য আমি ২০১২ সালের ডিসেম্বরে রিচার্ড নিক্সন প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরি অ্যান্ড মিউজিয়ামে একটি আইনি দরখাস্ত দাখিল করি। যথেষ্ট আইনি লড়াইয়ের পর অবশেষে ২০১৮ সালের মে ও ২০১৯ সালের জুলাই মাসে কিছু টেপ থেকে অস্পষ্টতা উঠিয়ে দিয়ে প্রকাশ করেছেন নিক্সন মহাফেজখানার সংরক্ষকেরা। ২০১৯ সালের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত এভাবে উন্মুক্ত করা হয়েছে আরও ২৮টি টেপ। (তবু কিছু টেপে এখনো প্রতিবন্ধকতা আছে, এগুলোও সরানোর জন্য আমি আবেদন করে যাচ্ছি।)

১৯৭১ সালের জুন মাসে ওভাল অফিসে নিক্সন, কিসিঞ্জার ও হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফ এইচ আর হ্যাল্ডম্যানের কথাবার্তা শুনলে হতভম্ব হতে হয়।

নিক্সন বলছেন, ‘নিঃসন্দেহে বিশ্বের সবচেয়ে কম আকর্ষণীয় হলো ভারতীয় নারীরা।’ ঘৃণাভরা কণ্ঠে তিনি আবার বলেন, ‘নিঃসন্দেহে আকর্ষণহীন।’

নিক্সন বলতে থাকেন, ‘এরা একেবারে যৌন আবেদনহীন, কিছুই নেই। আমি বোঝাতে চাচ্ছি, লোকে বলে, কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানরা কেমন? তুমি তাদের মধ্যেও কিছু না কিছু দেখার মতো পাবে। তার মানে, তাদের মধ্যেও অন্য প্রাণীদের মতো কিছু আকর্ষণ আছে; কিন্তু হায় ঈশ্বর, ওই ভারতীয়রা যাচ্ছেতাই।’

১৯৭১ সালের ৪ নভেম্বর, তৎকালীন বিরল নারীনেত্রী, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে হোয়াইট হাউসে উত্তেজনাপূর্ণ বৈঠক করেন প্রেসিডেন্ট নিক্সন। বৈঠকের বিরতিতে ভারতীয় নারীদের ব্যাপারে নিজের যৌন বিতৃষ্ণা নিয়ে কিসিঞ্জারের কাছে প্রায় এক বক্তৃতা দিয়ে বসেন প্রেসিডেন্ট।

নিক্সন বলেন, ‘আমার মনে হয়, এরা আমাকে নিস্তেজ করে ফেলে। এরা অন্যদের কীভাবে উজ্জীবিত করবে, বলো হেনরি?’ তাঁর এই কথার জবাবে কিসিঞ্জার কী বলেছিলেন তা শুনতে পাওয়া না গেলেও, তিনি প্রেসিডেন্টকে তাঁর আলোচ্য বিষয়ে নিরুৎসাহিত করতে পারেননি।

ভারতীয় নারীদের ব্যাপারে নিজের যৌন বিতৃষ্ণা যে পররাষ্ট্রনীতি নির্ধরণেও প্রভাব ফেলছে, পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানোর বিপদ সম্পর্কে মিসেস গান্ধীর সঙ্গে তিক্ত বাদানুবাদের ফাঁকে কিসিঞ্জারকে সে ইঙ্গিত দেন প্রেসিডেন্ট। তাঁর কথায়, ‘তারা আমাকে নিস্তেজ করে ফেলে। তারা বিরক্তিকর, তাই তাদের ব্যাপারে কঠোর হওয়া কোনো ব্যাপারই না।’

এর কয়েক দিন পর ১৯৭১ সালের ১২ নভেম্বর কিসিঞ্জার ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম পি রজার্সের সঙ্গে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা নিয়ে আলাপ করছিলেন নিক্সন। আলাপের মধ্যে মিসেস গান্ধীকে তিরস্কার করার কথা কিসিঞ্জার স্মরণ করিয়ে দিলে প্রেসিডেন্ট বেফাঁস বলে ফেলেন, ‘আমি বুঝি না, এরা কীভাবে সন্তান জন্ম দেয়!’

নিক্সনের হোয়াইট হাউসেও নিজে বর্ণবাদের ঊর্ধ্বে ছিলেন বলে দাবি করে থাকেন কিসিঞ্জার। কিন্তু টেপগুলো থেকে জানা যাচ্ছে, নিক্সনের গোঁড়ামিপূর্ণ কথাবার্তায় তিনিও যোগ দিতেন। যদিও এ থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় না যে তিনি প্রকৃতই প্রেসিডেন্টের মতো বিদ্বেষী ছিলেন, নাকি শুধু তাঁর কথার সঙ্গে সুর মেলাতেন।

১৯৭১ সালের ৩ জুন কিসিঞ্জার ভারতীয়দের প্রতি ক্ষোভ ঝাড়েন। অথচ ওই সময়ে পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে বাঁচতে পলায়নপর লাখ লাখ আতঙ্কিত বাঙালি শরণার্থীকে আশ্রয় দিচ্ছিল ভারত। বাঙালি বিদ্রোহীদের গোপনে সহায়তা দেওয়ার ফলেই দৃশ্যত শরণার্থীদের এই ঢলের সৃষ্টি, এমন কথা বলে ভারতকে দোষারোপ করেন তিনি। এরপর তিনি সব ভারতীয়েরই নিন্দা করেন। ঘৃণা ঝরে পড়ে তাঁর কণ্ঠে, ‘এরা সব আবর্জনার স্তূপ হাতড়ে বেড়ানো মানুষ।’

১৯৭১ সালের ১৭ জুন, একই বিষয়ে আলোচনার সময় আবার ‘যৌন আবেদনহীন’ ভারতীয় নারীদের নিয়ে ক্ষোভ ঝাড়েন নিক্সন। এ সময় তিনি ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ বি কিটিংয়ের ওপর রাগে ফেটে পড়েন। দুদিন আগেই ওভাল অফিসে নিক্সন ও কিসিঞ্জারের সঙ্গে তর্কে জড়িয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, পাকিস্তানের দমনাভিযান ‘প্রায় পুরোপুরি গণহত্যার শামিল’।

ওই আলোচনায় নিক্সন জিজ্ঞাসা করেন, ‘ভারতীয়দের কী আছে যে তারা ৭০ বছর বয়সী খ্রিষ্টান কিটিংকে বশ করে ফেলল।’ এ সময় অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দেরও ব্যবহার করেন তিনি, যা শুনতে ‘ব্যাচেলর’ বা ‘বেজন্মা’, এমন হতে পারে। জবাবে তড়িঘড়ি করে কিসিঞ্জার বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট, এরা হলো দারুণ চাটুকার। তোষামোদ করায় পটু। সূক্ষ্ম চাটুকারিতায় দক্ষ। এ কারণেই এরা ৬০০ বছর ধরে টিকে আছে। এরা পা চাটে, গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা মানুষের পা চাটাই এদের বড় দক্ষতা।’

কিসিঞ্জারের কথাবার্তায়ও পাকিস্তানিদের প্রতি তাঁর পক্ষপাতের বিষয়টি ফুটে ওঠে। ১৯৭১ সালের ১০ আগস্ট নিক্সনের সঙ্গে আলাপচারিতায় বন্দী বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতাকে পাকিস্তানি জান্তা মৃত্যুদণ্ড দেবে কি না, সে বিষয়ে তিনি প্রেসিডেন্টকে বলেন, ‘আপনাকে বলি, পাকিস্তানিরা ভালো লোক, কিন্তু তারা সেই আদিম মনমানসিকতার।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভারতীয়দের মতো সূক্ষ্ম চতুরতা তাদের মধ্যে নেই।’

পক্ষপাতিত্বের এই আবেগের প্রকাশ নিক্সন ও কিসিঞ্জারের বিধ্বংসী পররাষ্ট্রনীতিকে ব্যাখ্যা করতে সহায়তা করে। ১৯৭১ সালে দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে তাঁদের অনুসৃত নীতি শুধু এক নৈতিক বিপর্যয়ই ছিল না, বরং স্নায়ুযুদ্ধের ক্ষেত্রেও এটা ছিল নিজেদের বিরাট কৌশলগত ব্যর্থতা।

পাকিস্তানকে সমর্থন করার পেছনে নিক্সন ও কিসিঞ্জারের কিছু কারণ ছিল; চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক প্রচেষ্টায় গোপনে সহায়তা করছিল মিত্র পাকিস্তান। পাকিস্তানের খুনি জান্তার নির্মমতার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মাত্রাতিরিক্ত সমর্থনের পেছনে ছিল নিক্সন ও কিসিঞ্জারের পক্ষপাতমূলক আচরণ ও আবেগ।

কিসিঞ্জারকে তাঁর নিজের কর্মকর্তারা যেমনটা সতর্ক করেছিলেন, ঘটেছিলও তা–ই। তাঁর এই একপেশে দৃষ্টিভঙ্গিই পাকিস্তানকে ভেঙে দেওয়ার সুযোগ এনে দেয় ভারতকে; প্রথমে বাঙালি গেরিলাদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান ও পরে একাত্তরের ডিসেম্বরে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। এটি সোভিয়েত শিবিরকেও স্নায়ুযুদ্ধে একটি জয় এনে দেয়।

কয়েক দশক ধরে নিক্সন ও কিসিঞ্জার নিজেদের বাস্তববাদী রাজনীতির বুদ্ধিদীপ্ত ধারক হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করে গেছেন। তাঁদের দাবি, তাঁদের পররাষ্ট্রনীতি পক্ষপাতহীনভাবে মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করে গেছে। কিন্তু প্রকাশিত হোয়াইট হাউসের এসব টেপ থেকে পাওয়া যাচ্ছে একেবারে ভিন্ন চিত্র। আর তা হলো, চূড়ান্ত পর্যায়ের বর্ণবাদী ও নারীবিদ্বেষী আচরণ তাঁরা দশকের পর দশক ধরে ঢেকে রেখেছেন জাতীয় নিরাপত্তার হাস্যকার দাবির আড়ালে। তাই নিরপেক্ষ ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে নিক্সন ও কিসিঞ্জারকে মূল্যায়ন করতে হলে অবশ্যই পুরো সত্য এবং প্রতিবন্ধকতাহীন তথ্যপ্রমাণ বিবেচনায় আনতে হবে।

(ঈষৎ সংক্ষেপিত)

গ্যারি জে ব্যাস: প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও পুলিৎজার পুরস্কারের জন্য চূড়ান্ত মনোনয়ন পাওয়া বই দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম: নিক্সন, কিসিঞ্জার অ্যান্ড এ ফরগটেন জেনোসাইড–এর লেখক।

অনুবাদ: আবু হুরাইরাহ