ফাঁকা সৈকতে লাল কাঁকড়ার ‘রাজত্ব’

করোনার বিধিনিষেধের কারণে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের বালুচরে এখন লাল কাঁকড়াদের অবাধ বিচরণ।ছবি: প্রথম আলো

মনে হবে যেন কোনো দক্ষ শিল্পীর নৈপুণ্যে বালু দিয়ে তৈরি করা আলপনা। থরে থরে সাজানো বালুর আলপনাগুলোর একটি অন্যটির চেয়ে আলাদা। যেন প্রতিটি আলপনায় রয়েছে ভিন্ন কোনো গল্প। এই দৃশ্য বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারের। আর বালু দিয়ে তৈরি নান্দনিক আলপনাগুলো শিল্পী হলো সৈকতের বাসিন্দা লাল কাঁকড়াগুলো। এগুলো শুধু আলপনা নয়, বরং আলপনাগুলোকে ঘিরেই লাল কাঁকড়াগুলোর জীবনযাপন। আলপনার ভেতরে-বাইরে গর্ত খুঁড়ে লাল কাঁকড়াগুলো নিজেদের বাসা বানায়।

করোনা সংক্রমণ রোধে গত ১ এপ্রিল থেকে সৈকতে পর্যটকসহ লোকজনের সমাগম নিষিদ্ধ করে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। ফলে আড়াই মাস ধরে সৈকত ফাঁকা পড়ে আছে। নির্জন সৈকতের বালুচরে দৌড়ঝাঁপে মেতে আছে হাজারো লাল কাঁকড়া। মনপ্রাণ উজাড় করে এদিক–সেদিক ছুটছে লাল কাঁকড়ার দল। কাঁকড়াগুলো এখন বাতাসের মতো স্বাধীন। নেই কুকুরের আক্রমণের ভয়। মানুষের নিষ্ঠুর আচরণে, পর্যটকবাহী বিচবাইকের চাকায় কিংবা ঘোড়ার খুরের তলায় পিষ্ট হয়ে প্রাণে মরার শঙ্কাও নেই।

লাল কাঁকড়াগুলোই বালু দিয়ে তৈরি এই নান্দনিক আলপনাগুলোর শিল্পী।
ছবি: প্রথম আলো

সৈকতের কোনো এক জায়গায় খানিকটা সময় দাঁড়িয়ে থাকলে লাল কাঁকড়ার স্বাধীন জীবনযাপন উপলব্ধি করা যায়। সৈকতের কলাতলী পয়েন্টে আড়াই মাস আগেও লাল কাঁকড়ার দেখা মিলত না। তখন পুরো সৈকতে পর্যটকসহ মানুষের সমাগম লেগে থাকত। এখন ফাঁকা সৈকতে চলে লাল কাঁকড়াগুলোর স্বপ্নের আঁকাআঁকি।

এগুলোর জীবন বেশ সুশৃঙ্খল। বড় কাঁকড়াগুলো যেদিকে যায়, ছোট কাঁকড়াগুলোও সোগুলোকে অনুসরণ করে, অনেকটা বাঘ কিংবা সিংহশাবকের মতো। আবার দেখা যায়, ঝুঁকি নিয়ে সাগরে নেমে মা কাঁকড়া খাবার সংগ্রহে মত্ত, এ সময় বাচ্চাগুলো দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। সাগরে নামলে মরণের হাতছানি—সেটিও বোঝে বাচ্চা কাঁকড়াগুলো। শক্ত খোলসবিশিষ্ট অমেরুদণ্ডী প্রাণী লাল কাঁকড়ার পা আছে আটটি। কিন্তু চলাচল কিংবা দৌড়ঝাপ ছয়টি পা দিয়ে। সামনের পা দুটি অপেক্ষাকৃত মোটা এবং এই পা দুটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে লাল কাঁকড়াগুলো। ধরতে চাইলে এই পা দুটি দিয়েই কামড় বসিয়ে দেয়।

পরিবেশবাদী সংগঠন কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা বলেন, লাল কাঁকড়ার জীবন বৈচিত্র্যে ভরপুর। পুরো শরীর লাল আর চোখ দুটি শুধু সাদা। এর আগে সৈকতে লাল কাঁকড়ার এমন স্বাধীন জীবন আর দেখা যায়নি। করোনা অতিমারি মানুষের জন্য অভিশাপ হলেও এই কাঁকড়াগুলোর জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। সৈকতের লোকজনের বিচরণ যত দিন বন্ধ থাকবে, লাল কাঁকড়ার সাম্রাজ্যও ততই বাড়তে থাকবে।

সমুদ্র থেকে মাছ ধরে বাড়ি ফিরছিলেন জেলে নুর মোহাম্মদ। প্রতিদিন সমুদ্রে নামা ও বাড়ি ফেরার মুহূর্তে তাঁর সঙ্গে অসংখ্য লাল কাঁকড়ার দেখা হয়। লাল কাঁকড়া নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতাও অনেক।
নুর মোহাম্মদ বললেন, এখন বর্ষাকাল, ঠান্ডা পরিবেশ বলে বালুচরে যখন–তখন লাল কাঁকড়ার দেখা মেলে। কিন্তু গরমকালে কাঁকড়ার দেখা মেলে সকাল ও বিকেলে। লাল কাঁকড়া মোটেও গরম সহ্য করতে পারে না, গরমের সময়টা সেগুলো গর্তের (বাসায়) ভেতরে লুকিয়ে থাকে।

আড়াই মাস আগেও সৈকতের কলাতলী পয়েন্টে লাল কাঁকড়ার দেখা মিলত না।
ছবি: প্রথম আলো

গরমের চেয়ে লাল কাঁকড়ার বড় শত্রু মানুষ। সৈকত ভ্রমণে আসা লোকজন তাড়া করে কাঁকড়া ধরতে চায়। শিশুরা গর্তের ভেতর থেকে কাঁকড়া ধরে রশি দিয়ে বেঁধে খেলা করে। মানুষের পায়ের তলায় পড়ে ভেঙে যায় লাল কাঁকড়ার বাসা। মারা যায় কাঁকড়ার অসংখ্য বাচ্চা। লাল কাঁকড়া যদি মানুষের খাওয়ার উপযোগী হতো, তাহলে সৈকতজুড়ে আর এগুলোকে দেখা যেত না। সব কাঁকড়া ধরে ধরে খেয়ে ফেলত মানুষ—রসিকতা করে কথাটি বললেন নুর মোহাম্মদ। তবে মানুষ না খেলেও লাল কাঁকড়া কুকুর ও গুইসাপের প্রিয় খাবার।

পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের সহকারী পরিচালক শেখ মো. নাজমুল হুদা বলেন, করোনা সংক্রমণ রোধে সৈকতে চলমান বিধিনিষেধে সৈকতের রূপ পাল্টেছে। গভীর সমুদ্র থেকে ডিম পাড়তে সৈকতে আসছে মা কচ্ছপ। বিশাল বালুচরে লাল কাঁকড়ার বিস্তার ঘটেছে অনেক। সৈকতে লোকসমাগম বেড়ে গেলে লাল কাঁকড়ার রাজত্বও সীমিত হয়ে আসবে। তখন লাল কাঁকড়ার কী হবে, সবার জানা।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, শহরের ডায়াবেটিক হাসপাতাল পয়েন্ট থেকে দক্ষিণ দিকে কলাতলী পয৴ন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার সৈকত এলাকায় পর্যটকসহ মানুষের সমাগম থাকে। উখিয়া, ইনানী ও টেকনাফ সৈকতের আরও ছয় কিলোমিটারজুড়ে লোকসমাগম থাকে।

এই ১১ কিলোমিটারের বাইরে অরক্ষিত আরও ১০৯ কিলোমিটার সৈকত রয়েছে। স্থানীয় পরিবেশবাদীরা মনে করেন, এই বিশাল সৈকত অঞ্চলকে কাঁকড়া, কচ্ছপসহ অন্যান্য প্রাণীর জন্য সংরক্ষিত অঞ্চল ঘোষণা করা হলে এই সৈকতকে প্রাণীর জন্য নিরাপদ অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।

কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আয়াছুর রহমান বলেন, ৪০–৫০ বছর আগের সৈকত ছিল লাল কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুক আর খনিজ বালুতে ভরপুর। এখন আর তেমন পরিবেশ নেই। যদিও করোনা মহামারির বিধিনিষেধে সৈকত আগের পরিবেশ ফিরে পাচ্ছে। হয়তো কিছুদিন পর বিধিনিষেধ থাকবে না। সৈকতে আবার পর্যটনকেন্দ্রিক ব্যবসাগুলো শুরু হয়ে যাবে। তখন যেন মানুষের নিষ্ঠুর আচরণে লাল কাঁকড়াসহ অন্যান্য প্রাণীর কোনো ক্ষতি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।