ফিরবে ঢাকার প্রসিদ্ধ মসলিন

হাতের আংটির ভেতর দিয়ে এক কোনা ধরে পুরো শাড়ি টেনে বের করা বা আস্ত বস্ত্রটি দেশলাইয়ের খোলের মধ্যে রাখা—এমন কথার সমার্থক হয়ে আছে ঢাকার মসলিন। অনন্য বৈশিষ্ট্যের কারণে জগৎজোড়া প্রসিদ্ধি এই মসলিনের। মোগল রাজদরবারে মসলিনের ব্যাপক সমাদর ছিল। কালের পরিক্রমায় হারিয়ে গিয়েছিল সেই মসলিন। বর্তমানে এটাকে ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে গবেষক দল। কাজ অনেকটা এগিয়েছে। গবেষকদের আশা, শিগগিরই বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হবে মসলিনের।

ঢাকার মসলিন খুব সূক্ষ্ম, মিহি ও মোলায়েম ছিল। এই মসলিনের সঙ্গে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে আছে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের নাম। এখানকার মসলিনের কারুকার্য যুগের পর যুগ প্রশংসিত হয়েছে। সোনারগাঁয়ের পানাম নগর ছিল মসলিন ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র।

সম্রাট জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনী তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী থেকে জানা যায়, সুবাদার ইসলাম খান সোনারগাঁয়ের তৈরি বিশেষ মসলিন কাপড় বাদশাহর দরবারে পাঠাতেন, তাতে লেখা থাকত ‘খাসনগর’। খাসনগর লেখা না থাকলে রাজদরবারে মসলিন নেওয়া হতো না। মূলত মসলিনের সর্বাধিক কদর ছিল মোগল আমলেই। তখন মসলিনের খ্যাতি এশিয়া ছাড়িয়ে অন্যান্য মহাদেশে চলে যায়। সে সময় সোনারগাঁয়ের শাসক ছিলেন ইতিহাসে বারভূঁইয়াখ্যাত ঈশা খাঁ।

সোনারগাঁয়ের খাসনগরসহ আশপাশের শতাধিক দিঘির স্বচ্ছ পানি ও ঠান্ডা বাতাস মসলিন ধুয়ে শুকানোর বিশেষ উপযোগী ছিল। প্রাচীনকালে বাংলা ভ্রমণে আসা বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের নজর কাড়ে মসলিনের বিশেষ বুনন ও নিখুঁত কাপড়।

চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বাংলায় এসেছিলেন মরক্কোর পরিব্রাজক ইবনে বতুতা। তিনি মসলিনে মুগ্ধ হয়ে মন্তব্য করেছিলেন, এমন উন্নত মানের বস্ত্র হয়তো সারা দুনিয়ায় আর কোথাও পাওয়া সম্ভব নয়।

মসলিন তৈরি হতো ‘ফুটি কার্পাস’ নামক গাছের তুলা থেকে। এটি অন্য জাতের তুলা থেকে ভিন্ন। দেশের কয়েকটি স্থানে এ তুলা জন্মাত। এর মধ্যে মেঘনা ও শীতলক্ষ্যা নদীর অববাহিকা অন্যতম। ঠান্ডা আবহাওয়া মসলিনের সুতা কাটার জন্য উপযোগী ছিল। ভোর থেকে নারীরা মসলিনের সুতা কাটতেন। সূর্য মাথার ওপর থাকলে সুতা কাটা সম্ভব হতো না। প্রাচীন মসলিন ৭০০ থেকে ৮০০ কাউন্টের সুতায় বোনা হতো। এ কারণে মসলিন কাপড় ছিল স্বচ্ছ।

পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের পর মসলিনের পৃষ্ঠপোষকতা কমতে থাকে। মসলিন ক্রমাগত বিলুপ্তির পথে চলে যায়। এর নেপথ্যে মসলিন শাড়ির ওপর ব্রিটিশদের অতিরিক্ত করারোপের কথা শোনা যায়। তাঁতকল চালুর পাশাপাশি স্থানীয়দের নীলচাষে বাধ্য করতে এই কৌশল নেওয়া হয় বলে ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়।

২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মসলিনকে ফিরিয়ে আনতে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন। এরপর দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রাকৃতিক অবস্থায় পাওয়া তুলার জাত সংগ্রহসহ মাঠে চাষ করে পরীক্ষা–নিরীক্ষার পরিকল্পনা করা হয়। গাছটি খুঁজে পাওয়ার জন্য প্রথমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার এক শিক্ষার্থীকে দিয়ে এর ছবি আঁকানো (স্কেচ) হয়। সেই ছবি দিয়ে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়।

এর মধ্যে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম তাঁর ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। এটা দেখে গাজীপুরের কাপাসিয়া এলাকার কলেজশিক্ষক মো. তাজউদ্দিন ফুটি কার্পাসের সন্ধান চেয়ে স্থানীয় বিভিন্ন স্কুল–কলেজে প্রচারপত্র বিলি ও মাইকিং করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের মার্চে গাজীপুরের কাপাসিয়া ও রাঙামাটি থেকে এ গাছের খবর আসে।

পরে গবেষকেরা নমুনা সংগ্রহ করেন। রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, সাজেক, বাগেরহাট, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম থেকে ৩৮টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। গবেষকেরা কাপাসিয়ার একটি গাছের জাতের সঙ্গে আঁকা ছবির মিল পান। দেশের অন্য কোনো উৎস থেকে নমুনা না পেয়ে গবেষকেরা মসলিনের নমুনা সংগ্রহের জন্য ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম, কলকাতায় যান। ওই মিউজিয়ামের বিশেষজ্ঞরা জানান, মুর্শিদাবাদে এখন যেসব মসলিন শাড়ি বানানো হচ্ছে, সেগুলো দক্ষিণ ভারতে উৎপাদিত তুলা থেকে তৈরি। এগুলো ঢাকার মসলিনের মতো মোলায়েম নয়। তাঁদের মতে, ঢাকার মসলিন তৈরি করতে হলে স্থানীয় জাত খুঁজে বের করে সেই তুলা দিয়ে এলাকাতেই করতে হবে। কারণ, মসলিন তৈরিতে তুলার জাত ও আবহাওয়ার বিশেষ ভূমিকা আছে।

গবেষক দল ভারতে ফল না পাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁদের যুক্তরাজ্যের লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়ামে যেতে বলেন। তিনি সেখানে ঢাকার মসলিন দেখেছিলেন। শেষ পর্যন্ত মসলিনের নমুনার জন্য ২০১৭ সালের চার সদস্যের একটি দল সেই মিউজিয়ামে যায়।

সেখানে মসলিন কাপড়ের নমুনা ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য–উপাত্ত পেয়ে যায় গবেষক দল। লন্ডনের মিউজিয়ামের মসলিনের সঙ্গে কাপাসিয়ার ফুটি কার্পাসগাছের মিল পাওয়া যায়। গবেষক দল নিশ্চিত হয়, এটিই কাঙ্ক্ষিত জাতের ফুটি কার্পাস।

তুলা থেকে ৫০০ কাউন্টের সুতা তৈরি করা চাট্টিখানি কথা নয়, এই সুতা আধুনিক যন্ত্রে হবে না, চরকায় কাটতে হবে—বিষয়টি বুঝতে পারে গবেষক দল। এবার খোঁজ শুরু হয়, দেশের কোথায় চরকায় সুতা কাটেন তাঁতিরা। খবর আসে, কুমিল্লার চান্দিনায় এখনো এই তাঁতিরা আছেন। তাঁরা খদ্দরের জন্য চরকায় মোটা সুতা কাটেন। তবে সেই সুতা কাউন্টের মাপে আসে না। নতুন করে এ সুতা কাটার জন্য চরকা তৈরি করা হয়। মসলিনের সুতা মিহি হয় তিন আঙুলের জাদুতে। তিন আঙুলে কীভাবে তুলা ছাড়তে হবে, সেটাই আবিষ্কার করতে হয়েছে। আর নারীদের আঙুলে এ সুতা সবচেয়ে বেশি মিহি হয়।

মসলিন পুনরুদ্ধার প্রকল্পের গবেষণার অগ্রগতি নিয়ে চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি পর্যালোচনা সভা হয়। ওই সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী।

গোলাম দস্তগীর গাজী বলেন, ‘গবেষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে আমরা হারানো মসলিনের পুনর্জন্ম দিতে অনেকটা সফল হয়েছি। ইতিমধ্যে ১৭১০ সালে বোনা মসলিন শাড়ির নকশা দেখে হুবহু একটি আমাদের দেশের তাঁতিরা বুনেছেন। প্রথম শাড়িটি তৈরি করতে খরচ হয় ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা।’

মসলিন পুনরুদ্ধার প্রকল্পের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মনজুর হোসেন বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমরা ৪০ জন তাঁতিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে মসলিন কাপড় তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। আশা করা যাচ্ছে, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে শিগগিরই দেশে মসলিনের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হবে।’