ফেসবুকে ‘উই’ নিয়ে ট্রল

উই’কে যারা ট্রল করছেন তাদের নিয়ে ট্রল করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন
ছবি: সংগৃহীত

ক্রিকেটারেরা যদি উই গ্রুপের উদ্যোক্তা হতেন তাহলে নিজেদের পরিচয় কীভাবে দিতেন? তার উত্তরও দেওয়া আছে। একজন ক্রিকেট বোর্ডের শীর্ষ কর্মকর্তা সম্পর্কে বলা হচ্ছে, আমি ....। কাজ অন্যরা করছে, কিন্তু আমিই বলেছিলাম।

একজন ক্রিকেটার সম্পর্কে বলা হয়েছে, আমি...। কাজ করছি ....(মেয়ের) আইসক্রিম খাওয়ার বায়না নিয়ে। আমার নাম...। কাজ করছি ফুডপান্ডা নিয়ে।

আর সিনেমার তারকারা যদি উই গ্রুপের উদ্যোক্তা হতেন তাহলে ফেসবুকে নিজের পরিচয় ও কাজ নিয়ে কী লিখতেন, সেটাও বলা হয়েছে।

এখানেই শেষ নয়, রাজনীতিবিদদের নামও যুক্ত হয়েছে এখানে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কিংবা বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নামও যুক্ত করে ট্রল করা হচ্ছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিভিন্ন রম্য গ্রুপ থেকে শুরু করে চিকিৎসক, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশা শ্রেণির প্রতিনিধিরা এই ধরনের ট্রলে অংশ নিয়েছেন। এ ট্রলটি মূলত শুরু হয়েছে ফেসবুকভিত্তিক নারী উদ্যোক্তাদের প্ল্যাটফর্ম উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই) বা উই নিয়ে। সাড়ে ৯ লাখ সদস্যের এই গ্রুপে উদ্যোক্তাদের ৮০ শতাংশই নারী। উদ্যোক্তারা উই গ্রুপে নিজেদের পরিচয় দেওয়ার আগে নিজের নাম লিখে তিনি কোন পণ্য নিয়ে কাজ করছেন তা উল্লেখ করেন। এ থেকেই ট্রলের সৃষ্টি। এখন সবাই নিজেদের মতো করে বা বলা যায় ব্যঙ্গ করে বলছেন, তিনি কোন বিষয় নিয়ে কাজ করছেন। আর সেই সব পোস্টের নিচের বিভিন্ন কমেন্টে উই এর সদস্যদের নিয়ে হাসাহাসি করছেন অনেকে। আবার কেউ কেউ এ ধরনের ট্রলের বিরোধিতাও করছেন।

ফেসবুকে বিষয়টি হাস্যরসের সৃষ্টি করলেও উই গ্রুপের অ্যাডমিন এবং সদস্যরা এ ধরনের ট্রলে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন। তাঁরা বলছেন, ট্রল করার মতো কোনো কাজ উই গ্রুপ করেনি। করোনাভাইরাসের বিস্তারের মধ্যেও উই গ্রুপের সদস্যরা ভালো ব্যবসা করেছেন। তৃণমূল পর্যায়ের নারীরাও লাখ লাখ টাকার ব্যবসা করছেন। উদ্যোক্তারা নিজেদের পরিচয় দিয়েই পণ্য বিক্রি করেন। শুধু উই গ্রুপ না, ফেসবুক বা অনলাইনের অন্য উদ্যোক্তারাও এভাবেই নিজেদের পরিচিতি তুলে ধরেন। উই এর সদস্য সংখ্যা বেশি হওয়ায় এবং উই এর সদস্যরা ফেসবুকে সক্রিয় থাকায় হয়তো বিষয়টি সবার চোখে পড়েছে।

ফেসবুকে উই গ্রুপকে কেন্দ্র করে ট্রলে অংশ নেওয়া একাধিকজনের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়েছে। তাঁরা বলছেন, ট্রলের পেছনে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো কারণ নেই। নারী উদ্যোক্তাদের হেয় করার জন্যও তা করা হয়নি। ফেসবুকে একটি ট্রেন্ড শুরু হয়েছে তাই ট্রলে অংশ নেওয়া। আবার কেউ কেউ বলছেন, উই গ্রুপের সদস্যরা নিজেদের প্রচার নিজেরাই যেভাবে করেন তা সমালোচিত হয়েছে। তাই ট্রল শুরু হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, ট্রলের পেছনে উই গ্রুপ থাকলেও তা ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার পর তা আর উই'তে আটকে নেই।

‘হতাশার চর্চা কেন্দ্র’ নামে একটি রম্য গ্রুপের একটি ট্রলের কথা উল্লেখ করে একজন বলেন,‘ আমি ফেসবুকে যেটা শেয়ার দিয়েছি তাতে লেখা আছে-‘আমি হীরক রাজা, আমি কাজ করছি উন্নয়ন ও গণতন্ত্র নিয়ে।’- এ দিয়ে কাউকে কিছু না বলেও কিন্তু অনেক কিছু বলা সম্ভব হয়েছে। তবে এটাও ঠিক ফেসবুকে ট্রলের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে নারী বা নারীর বিষয়ে বেশি আটকে থাকে। কোনো নারী বা নারীগোষ্ঠীকে হেয় করার জন্য করা হলে অবশ্যই তা নেতিবাচক।’

উই গ্রুপ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে ২০১৭ সালের ২৫ অক্টোবর। অনলাইনে উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ, পণ্য বিক্রির কৌশল শেখানোসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার দেশীয় পণ্যের প্ল্যাটফর্ম এটি। উই এর সদস্য হিসেবে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ক্রেতাও আছেন। এ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান নাসিমা আক্তার (নিশা)। তিনি ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের জয়েন্ট সেক্রেটারি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি জানালেন, হুইলচেয়ারে বন্দী থাকা পাবনার জান্নাতুল ফেরদৌস (মহুয়া) , কুমিল্লার সীমান্তবর্তী একটি গ্রামের মেয়ে জান্নাতুল মুক্তাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের নারীরা করোনাভাইরাসের বিস্তারের ভয়াবহ সময়েও ঘরে বানানো পোশাক, কুমিল্লার খাদি বা ঘরে বানানো চকলেটসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করে লাখপতি হয়েছেন। করোনার সময়ে চাকরি হারানো নারীরাও বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে উই’তে যুক্ত হয়েছেন।

পাক্ষিক অনন্যার বছরের আলোচিত নারী ‘অনন্যা শীর্ষদশ ২০১৯’ সম্মাননা পাওয়া নাসিমা আক্তার বললেন, ‘একটা প্ল্যাটফর্ম যেমন চাইলেই বানানো যায় না, আবার তা চালানোর জন্যও অনেক শ্রম দিতে হয়। চ্যালেঞ্জতো আছেই। ফেসবুকে আমাদের বিপক্ষে আরও অনেক গ্রুপ বের হল, নাম থেকে শুরু করে নীতি পর্যন্ত কপি করল, আমাদের কোনো উদ্যোক্তা ভালো করলে তাঁদের নিয়ে উপহাস করে মানুষকে বিভ্রান্ত করারও চেষ্টা চালাচ্ছেন অনেকে। গ্রুপের সদস্য হয়ে পোস্ট দিয়ে পরে তাতে বিভিন্ন বাজে তথ্য সংযোজন করে স্ক্রিনশট নিয়ে তা ফেসবুকে কেউ কেউ ছড়িয়ে দিয়েও উই’র ক্ষতি করার চেষ্টা করেছেন। তবে আমাদের নিয়ে যতই ট্রল হোক বা ক্ষতি করার চেষ্টা করা হোক আমরা আমাদের কাজ চালিয়ে যাব। আমরা ভালো কাজ করছি বলেই হয়তো মানুষ ট্রল করছে।’

নাসিমা আক্তার জানালেন, কারও দেশীয় পণ্য নিয়ে কোনো উদ্যোগ থাকলে তিনি উই’র নিয়ম মেনে পোস্ট দিতে পারেন। এখানে পোস্ট দিতে কোনো টাকা লাগে না। বিক্রেতা পণ্য বিক্রি করলেও কোনো কমিশন দিতে হয় না। তবে উই এর সদস্য কোনো উদ্যোক্তার পণ্য নিয়ে ক্রেতা কোনো অভিযোগ থাকলে তা সমাধান করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। সরকারের হাইটেক পার্কসহ বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে কাজ করছে উই। আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষকদের কাছে নারী উদ্যোক্তারা প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। উই সরকারের কোনো নীতিমালা ভঙ্গ করেছে সে ধরনের অভিযোগও কেউ দিতে পারবে না। তাই উই ট্রলে ভয় পায় না।

উই নিয়ে ট্রল বা মিম বানিয়েছে অনলাইন রম্য পত্রিকা ই-আরকি। এ পত্রিকার সম্পাদক সিমু নাসের প্রথম আলোকে বলেন, ‘উই এর কোনো অভিযোগের ভিত্তিতে মিমগুলো বানানো হয়েছে বিষয়টি তেমন না। এ ধরনের মিমের পেছনে সব সময় নেতিবাচক উদ্দেশ্য থাকে বিষয়টিও তেমনও না। ফেসবুকে এখন তেমন কিছু নেই, তাই উই’কে কেন্দ্র করে বানানো মিমগুলো মানুষ পছন্দ করছে। এতে উই’র প্রচারও বাড়ছে। দুইদিন পরই দেখা যাবে মানুষ অন্য কিছু নিয়ে মেতেছে।’

উইকে নিয়ে যেভাবে ট্রল করা হচ্ছে, এর আগে বড় গ্রুপ ধরে ট্রল তেমন চোখে পড়েনি। তবে ব্যক্তি পর্যায়ে কেউ গান গাওয়ার জন্য, কেউ রান্না করা বা মটিভেশনাল স্পিচ দেওয়ার কারণেও অনেকে ফেসবুকে ট্রলের শিকার হয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতিআরা নাসরীন বললেন, ‘একটি নবীন উদ্যোক্তাদের প্ল্যাটফর্মে উদ্যোক্তারা নিজেদের কীভাবে উপস্থাপন করেন এ নিয়ে হঠাৎ ফেসবুকে নানা ধরনের ব্যঙ্গাত্মক উপস্থাপন দেখে আমি ক্ষুব্ধ বোধ করেছি! এই প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে আমি কোনো ভাবেই যুক্ত নই, তারপরেও আমার এই ভেবে খারাপ লেগেছে যে, এই নবীন উদ্যোক্তারা তো কারও ক্ষতি করছেন না, তাঁদের দলবদ্ধভাবে শিশুদের মতো এভাবে ভেঙ্চি কাটা হচ্ছে কেন?’

অধ্যাপক গীতিআরা নাসরীন বলেন, কোভিড ১৯ এর এই সংকটকালে নানা ধরনের অনলাইন ব্যবসা ও সেবা বিস্তার লাভ করেছে। এতে সেবাদাতা ও গ্রহীতা উভয়ের উপকার হচ্ছে। যদি বিক্রয় পদ্ধতিতে অথবা সেবাদানে কোনো সমস্যা থাকে, তবে, অবশ্যই তা নিয়ে যথোচিত সমালোচনা করতে হবে। যদি নতুন উদ্যোক্তাদের কোনো পরামর্শ দেওয়ার থাকে তাও দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে তাঁদের উপস্থাপনার ধরন নিয়ে হেয় করে তাঁদের এই সংকটকালে শুধু নিরুৎসাহিত নয়, সামাজিকভাবে অপদস্থ করা হচ্ছে। এতে সংকট আরও বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।