ফ্ল্যাটের দাম নিয়ে গৃহায়ণের চালাকি

৭৭ লাখ টাকার ফ্ল্যাটের দাম ৬৪ লাখ দেখিয়ে বরাদ্দ। হস্তান্তরের আগমুহূর্তে কর্তৃপক্ষ ১৪ লাখ টাকা বেশি চাইছে

স্বপ্ননগর আবাসিক প্রকল্প। গতকাল রাজধানীর মিরপুর ৯ নম্বর এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

সরকারি সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আছে। অব্যবস্থাপনার অভিযোগও কম নয়। কিন্তু সাধারণ মানুষের সঙ্গে চালাকি করা হয়েছে, এমন অভিযোগ শোনা যায় না। এবার নজির তৈরি করল জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ।

চালাকিটা করা হয়েছে ফ্ল্যাট বিক্রিতে। অভিযোগ, প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী ফ্ল্যাটের দাম দাঁড়িয়েছিল প্রায় ৭৭ লাখ টাকা। কিন্তু এত দামে ঢাকার মিরপুর ৯ নম্বর সেকশনে ফ্ল্যাট বিক্রি হবে না। তাই আকর্ষণ বাড়াতে দাম ১৩ লাখ টাকা কম দেখিয়ে প্রসপেক্টাস বিক্রি করা হয়। এ দামে গ্রাহকদের সাময়িক বরাদ্দপত্রও দেওয়া হয়। কিন্তু চূড়ান্তভাবে হস্তান্তরের সময় গৃহায়ণ বলছে, ফ্ল্যাটের দাম দিতে হবে ৭৮ লাখ টাকা, যা প্রসপেক্টাসের চেয়ে ১৪ লাখ টাকা বেশি।

গৃহায়ণের স্বপ্ননগর আবাসিক প্রকল্পে (পর্ব-১) এ ঘটনা ঘটেছে। রাজধানীর মিরপুরের কালশীতে (ডিওএইচএস চত্বরের কাছে) স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য ১১ একর জমিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। এতে ১০টি ১৪ তলা ভবনে নির্মিত হচ্ছে ১ হাজার ৪০টি ফ্ল্যাট।

প্রকল্পে তিনটি পৃথক আয়তনের ফ্ল্যাট রয়েছে। ১৪ লাখ টাকা দাম বাড়ানো হয়েছে ১ হাজার ৫৪৫ বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে। আর বাকি দুই ক্ষেত্রে দাম বাড়ানো হয়েছে ১০ লাখ টাকা করে। ১ হাজার ৩৩৮ বর্গফুটের ফ্ল্যাটের নতুন দাম ধরা হয়েছে প্রায় ৬৮ লাখ টাকা। আর ৮৭৮ বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাটের দাম ধরা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪৪ লাখ টাকা।

এ প্রকল্পের ফ্ল্যাটমালিকদের সমিতির সভাপতি আজিজ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ফ্ল্যাটের দাম এক লাফে ১৪ লাখ টাকা বাড়ানো দুঃখজনক। বরাদ্দের সময় গৃহায়ণ এই দাম জানালে অনেকেই ফ্ল্যাট নিতেন না। তিনি জানান, ফ্ল্যাটের বর্ধিত দাম পুনর্বিবেচনার জন্য দুবার আবেদন করা হয়েছিল। তবে কাজ হয়নি। আবারও আবেদন করা হয়েছে।

নথিপত্র ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, স্বপ্ননগর আবাসিক প্রকল্পের (পর্ব-১) ডিপিপি (প্রকল্প প্রস্তাব) অনুমোদিত হয় ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। ডিপিপিতেই দেড় হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাটের দাম ৭৭ লাখ ২২ হাজার টাকা ধরা হয়েছিল। ডিপিপি অনুমোদনের ৪ মাস পর ২০১৫ সালের মে মাসে ফ্ল্যাট বরাদ্দের জন্য প্রসপেক্টাস বিক্রি শুরু করে গৃহায়ণ। তখন প্রসপেক্টাসে দেড় হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাটের দাম ৬৪ লাখ ৪৬ হাজার টাকা দেখানো হয়। ফ্ল্যাটগুলো ২০১৮ সালের জুনে বরাদ্দ প্রাপ্ত ব্যক্তিদের বুঝিয়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে পারেনি। ২০২১ সালে এসে এখন ফ্ল্যাট গ্রাহকদের কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করেছে তারা। বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে দাম।

গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের ঢাকা বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জোয়ারদার তাবেদুন নবী প্রথম আলোকে বলেন, নির্মাণ শেষে ফ্ল্যাটের দাম কমবেশি হতে পারে, সেটা প্রসপেক্টাসে উল্লেখ ছিল। গ্রাহকদের সুবিধার জন্য বর্ধিত মূল্যের সুদ মওকুফ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, প্রসপেক্টাসে বলা হয়েছিল যে নির্মাণকাজ চলার সময় নির্মাণসামগ্রীর মূল্য, সরকারের কর, দরপত্র মূল্য ও কাজের পরিমাণ ইত্যাদি কারণে ব্যয় বাড়লে বা কমলে ফ্ল্যাটের দামের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। তবে প্রশ্ন উঠেছে, ডিপিপিতে যে দাম প্রাক্কলন করা হয়েছিল, তার চেয়ে কম দেখিয়ে কেন গ্রাহকদের কাছে ফ্ল্যাট বিক্রি করা হলো। আর নির্মাণ শেষে প্রায় ২২ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি গ্রহণযোগ্য কি না।

গ্রাহকেরা জানিয়েছেন, আগের দাম অনুযায়ী ফ্ল্যাটের দামের অর্ধেক টাকা তাঁরা পরিশোধ করেছেন। দেড় হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাটে বাকি ৩২ লাখ টাকা ১৬ বছরের কিস্তিতে দেওয়ার কথা। তাতে মাসিক কিস্তির পরিমাণ দাঁড়াত ৩৩ হাজার টাকা।

গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ গ্রাহকদের জানিয়েছে, বর্ধিত ১৪ লাখ টাকার অর্ধেক হস্তান্তর বুঝে নেওয়ার আগে পরিশোধ করা যাবে। বাকি টাকা ৯ শতাংশ সরল সুদে ১৬ বছরের মাসিক কিস্তিতে পরিশোধ করা যাবে। সে ক্ষেত্রে মোট মাসিক কিস্তি হবে ৩৮ হাজার ৫০৯ টাকা। আর কেউ যদি বর্ধিত মূল্যসহ ফ্ল্যাটের বাকি টাকা কিস্তিতে পরিশোধ করতে চায়, তাহলে মাসিক কিস্তি দাঁড়াবে ৪৫ হাজার ২৮৯ টাকা।

ফ্ল্যাট বরাদ্দ পাওয়া ব্যবসায়ী মেসবাহ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাড়তি টাকা কীভাবে দেব, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।’

স্বপ্ননগর আবাসিক প্রকল্পে খেলার মাঠ, হাঁটাপথ, ছয়তলা কমিউনিটি ভবনসহ নানা সুবিধা রয়েছে। ৩১ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের নিজস্ব পয়োবর্জ্য শোধনাগার নির্মাণ করা হয়েছে।

মিরপুর ৯ নম্বর সেকশনেই স্বপ্ননগর আবাসিক প্রকল্পের (পর্ব-২) কাজ চলছে। এ প্রকল্পে ডিপিপির ও প্রসপেক্টাসের মধ্যে ফ্ল্যাটের মূল্যে হেরফের মাত্র এক লাখ টাকা।

নগরবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, যেনতেনভাবে প্রকল্পে গ্রাহক আনা হবে। তারপর দাম বাড়িয়ে দেওয়া হবে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ এমন কাজ করতে পারে না। যাঁদের জন্য এমন পরিস্থিতি হয়েছে, তাঁদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।