ফড়িয়া হটিয়েছে অনলাইন

আগে মহাজনদের কাছে বিক্রি করে মজুরি পেতেন ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। এখন নিজেরা অনলাইনে বিক্রি করে পাচ্ছেন ১ হাজার ২০০ থেকে দেড় হাজার টাকা।

মণিপুরি তরুণী সনজিতা দেবী নিজেই মণিপুরি পোশাক বুনে অনলাইনে বিক্রি করেন। সম্প্রতি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার হোমেরজান গ্রামেছবি: আনিস মাহমুদ

‘কাপড়টি কি আসলেই মণিপুরিদের। আপনি নিজেই এটা বানিয়েছেন?’ নিজের হাতে তৈরি শাড়ির ছবি তুলে বিক্রির জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দেন সনজিতা দেবী। সেখানে এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হন তিনি। প্রথমে কিছুটা মন খারাপ হয়েছিল তাঁর। পরে তিনি ওই গ্রাহককে বুঝিয়ে বলেন। বিক্রির পর তাঁর কাছ থেকে ভালো ‘রিভিউ’ পান সনজিতা।

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের হোমেরজান গ্রামের বাসিন্দা সনজিতা দেবী মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের স্নাতক শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী । পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি মণিপুরি শাড়ি, ওড়না, ইন্নাফি (মণিপুরিদের বিশেষ ওড়না), চাদর বোনেন। পরে মুঠোফোনে ছবি ও ভিডিও ধারণ করে অনলাইনে ছাড়েন বিক্রির জন্য।

সনজিতার মতো অনেক মণিপুরি তরুণ কারুশিল্পী ও তাঁতি এখন অনলাইনে নিজেদের তৈরি কাপড় সরাসরি গ্রাহক পর্যায়ে বিক্রি শুরু করেছেন। এতে কমেছে ফড়িয়াদের তৎপরতা। আগের চেয়ে বেশি লাভও হচ্ছে তাঁদের।

মণিপুরি কারুশিল্পী ও তাঁতিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁদের তৈরি শাড়ি, ওড়না, চাদর, থ্রি-পিচ, ফতুয়া, পুতুল- নানা জিনিসের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বাজারে। তবে এসব পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতেন মহাজনেরা। মহাজনেরা কম দামে তাঁদের কাছ থেকে জিনিস কিনে বেশি দামে গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করতেন। তাঁতিদের ভাগে থাকত না কিছুই।

এর মধ্যে করোনা পরিস্থিতির শুরুর পর বাজারে মন্দা দেখা দেয়। দোকানপাট বন্ধ থাকায় বেচা-কেনা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এ থমকে যাওয়া সময়টাতেই মণিপুরি তাঁত, কারু এবং হস্তশিল্পীরা দেখেছেন নতুন আশার আলো। দোকান-পাট বন্ধ থাকায় নিজেরাই সেগুলো অনলাইনে বিক্রি শুরু করেন।

সনজিতা দেবীর পেজের নাম ‘নুংশি ফিজল’। মণিপুরি এ শব্দের অর্থ ‘ভালোবাসার কাপড়’। তিনি বলেন, ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে মায়ের সঙ্গে কাপড় বুননের হাতে খড়ি। আগে মহাজনদের কাছে মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার মতো কাপড় বিক্রি করতেন। এখন একই কাপড় অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে প্রায় ৩০ হাজার টাকায়।

গ্রাহকদের বিশেষ চাহিদা অনুযায়ী শাড়ি এবং অন্য কাপড়গুলোতে নকশা এবং কাজে ভিন্নতা এনেছেন জানিয়ে তিনি আরও বলেন, মণিপুরিদের নকশা এবং কারুকাজ নকল করে অনেকে কাপড় বানিয়ে থাকেন। সুতার মধ্যেও রয়েছে ভিন্নতা। সেগুলোর গুণগত মান নিয়ে গ্রাহকদের অসন্তুষ্টি রয়েছে। কিন্তু গ্রাহকেরা যদি মণিপুরি হস্তশিল্প ও কারুশিল্পীদের তৈরি কাপড়গুলো ব্যবহার করতেন তাহলে এমন প্রতিক্রিয়া আসার কথা ছিল না। কারণ মণিপুরি শিল্পীদের হাতে বানানো কাপড়ের সঙ্গে অন্যদের কাপড় বুননের অভিজ্ঞতার তফাত রয়েছে।

মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নন্দীতা দেবী ‘লৈকন’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপ চালান। তাঁর সঙ্গে আরও ৭ বান্ধবী গ্রুপটি পরিচালনা করেন। করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই তাঁরা ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে নিজেদের তৈরি কাপড় বিক্রি করা শুরু করেন। নন্দীতা বলেন, একেকটি শাড়ি বানাতে ৩ থেকে ৪ দিন সময় লাগে। এর জন্য দুজন তাঁতি প্রয়োজন। আগে মহাজনদের কাছে বিক্রি করে মজুরি পেতেন ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। এখন সেটি নিজেরা বিক্রি করে আয় আসছে ১ হাজার ২০০ থেকে দেড় হাজার টাকা।

‘মণিপুরি ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন’ (মিডো) সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক ওইনাম পামহৈবা নির্মল সিংহ বলেন, আগে ব্যবসা ফড়িয়াদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। করোনা পরিস্থিতিতে পর্যটন ও দোকানপাট বন্ধ থাকায় ফড়িয়ারাও অনেকটা নিজেদের গুটিয়ে রেখেছিলেন। এতে বেকায়দায় ছিলেন মণিপুরি তাঁত ও হস্তশিল্পীরা। কিন্তু এরই মধ্যে তাঁরা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। মণিপুরি তাঁতিদের সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিলে প্রচার-প্রসার আরও বাড়বে।

পথ দেখালেন রাধা বতী দেবী

মণিপুরি পোশাকের নকশাকার গুরুমাতা খ্যাত রাধা বতী দেবী
প্রথম আলো

সালটা ১৯৯২। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাঝেরগাঁও গ্রামের বাসিন্দা রাধা বতী দেবী সিলেট শহরে যান। চিকিৎসকের সাক্ষাৎকারের জন্য বাইরে বসে ছিলেন। রাধা সে সময় নিজের হাতে তৈরি নীল রঙের মধ্যে হলুদ পাড়ের একটি বিশেষ ওড়না পরেছিলেন। তা দেখে এক নারী সেটি সম্পর্কে জানতে চান। ওড়নার নকশায় শাড়ি বানিয়ে দিতে পারবেন কিনা জানতে চান। এরপর ৮৫০ টাকা দরে চারটি শাড়ি বোনার অর্ডার পান রাধা। পরে তাঁর বোনা সে শাড়ির নাম হলো ‘মণিপুরি শাড়ি’।

সেই থেকে শুরু। এরপর সিলেটের আরও কয়েকজনের কাছ থেকে শাড়ি তৈরির বায়না আসে রাধার কাছে। রাধা (৬৬) বলেন, শিশু বয়সে মায়ের হাত ধরে মণিপুরি কাপড় তৈরিতে হাতেখড়ি হয় তাঁর। পরে কিশোর বয়সে পার্শ্ববর্তী গ্রাম মঙ্গলপুরের থারোঙাউবি দেবীর কাছ থেকে মণিপুরি তাঁতের বিশেষ কিছু কাজ শেখেন তিনি। এরপর কিছুদিন ভারতের মণিপুর রাজ্যে গিয়ে আরও কাজ শেখেন।

১৯৯৪ সালের দিকে একসঙ্গে ৪০ হাজার টাকার মণিপুরি শাড়ির অর্ডার পান তিনি। তবে সে সময় শাড়ি বানানোর কেউ ছিল না। পরে নিজে তদারকি করে পরিচিত ১০ জনকে শাড়ি বোনার কাজ শেখান। অর্ডারের সংখ্যা বাড়তে থাকায় ওই বছর তিনি সিলেট শহরের একটি কার্যালয় ইজারা নেন। তাঁর সঙ্গে কাজ করতেন আরও ১০ জন। তাঁদের থাকা, খাওয়া থেকে শুরু করে বেতন–ভাতার দায়িত্ব তিনি নেন।

এখনো রাধা বতী দেবী মণিপুরি অধ্যুষিত বিভিন্ন এলাকায় প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। তাঁতশিল্পে তাঁর বিশেষ অবদানের জন্য ২০২০ সালে বাংলাদেশ মণিপুরি আদিবাসী ফোরাম তাঁকে ‘নকশাকার গুরু মাতা’ উপাধি দেয়।

রাধা বতী দেবী বলেন, বর্তমানে বাজারে মণিপুরি শাড়িসহ বিভিন্ন জিনিসের বিপুল চাহিদা। তবে তদারকি নেই। শুধু কাপড়ের আগে ‘মণিপুরি’ নাম যুক্ত করে অনেকে ব্যবসা করছেন। মহাজনেরা কম মূল্যে ও কম মজুরিতে এসব কাপড় তৈরি করানোয় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।