বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী ‘নওয়াব বাড়ি’ (নওয়াব প্যালেস) শেষ পর্যন্ত বিক্রি হয়ে গেছে। অভিযোগ উঠেছে, দাম কম দেখিয়ে নওয়াব পরিবারের দুই উত্তরসূরির কাছ থেকে স্বল্পমূল্যে এটি কিনেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির ছেলেসহ শহরের তিন ব্যবসায়ী। বাড়িটি প্রত্নসম্পদ হিসেবে ঘোষণার কাজ করছিল সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে বিক্রি হওয়ায় শহরবাসীর মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, বগুড়ার এই ঐতিহ্য কি তবে হারিয়ে যাবে?
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর স্মৃতিবিজড়িত প্রাচীন ঐতিহ্যের সাক্ষী ‘নওয়াব প্যালেস’ ওয়াকফ সম্পত্তি বলেই পরিচিত। এ কারণে তা হস্তান্তরযোগ্য নয়। তবে ক্রেতারা বলেছেন, এটি ওয়াকফ সম্পত্তি নয়। এ ব্যাপারে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর প্রথম আলোকে বলেন, ‘নবাব প্যালেস ওয়াকফ সম্পত্তি কি না, তা আমাদের জানা নেই। ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে কোনো গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন থাকলেও তা অন্তত ১০০ বছরের পুরোনো না হলে রাষ্ট্র তার অধিকার প্রয়োগ করতে পারে না। এসব মিলিয়ে একটি জটিলতা ছিল। ফলে আমরা বেশি দূর এগোতে পারিনি। তবে ক্রেতারা এই ঐতিহ্যমণ্ডিত স্থাপনাটি রেখেই তাকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করতে পারেন। বিদেশে অনেক ঐতিহাসিক ভবন এভাবেও সংরক্ষণ করা হয়েছে।’
গত শুক্রবার বগুড়া সদর সাব-রেজিস্ট্রার ঢাকায় গিয়ে নওয়াবের দুই পুত্র সৈয়দ হামদে আলী ও সৈয়দ হাম্মাদ আলীর কাছ থেকে নওয়াব প্যালেসের ১ একর ৫৫ শতাংশ সম্পত্তির দলিলে স্বাক্ষর নেন। রোববারের কার্যদিবসে তা সম্পাদন দেখানো হয়। বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিনের ছেলে এবং জেলা শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি মাসুদুর রহমান, সমিতির সহসভাপতি ও হাসান গ্রুপের কর্ণধার শফিকুল হাসান এবং সাবেক সহসভাপতি ও শাহ সুলতান গ্রুপের কর্ণধার আবদুল গফুর এই সম্পত্তির ক্রেতা।
জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ও বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের মহাসচিব তৌফিক হাসান বলেন, ‘নওয়াব প্যালেস বগুড়ার অমূল্য সম্পদ। এটি কোনোভাবেই বিক্রয়যোগ্য সম্পত্তি নয়। এটি গোপনে বিক্রি করে দেওয়ার বিষয়টি দুঃখজনক। নাগরিক কমিটি দুর্বার আন্দোলনের মাধ্যমে এটি রক্ষা করবে।’
পেশাজীবীরা বলছেন, শহরের সার্কিট হাউস-সংলগ্ন ওই এলাকায় প্রতি শতাংশ সম্পত্তির বাজারমূল্য গড়ে কোটি টাকা। সেই হিসাবে নওয়াব প্যালেসের বাজারমূল্য কমপক্ষে দেড় শ কোটি টাকা। অথচ মাত্র ২৭ কোটি ৬০ লাখ টাকায় বিক্রি দেখিয়ে মোটা অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকির ঘটনা ঘটেছে।
শহরের সাতমাথা-সংলগ্ন করতোয়া নদীর ডান তীর ঘেঁষে বিশাল এলাকাজুড়ে ‘মোহাম্মদ আলী প্যালেস’ নামের নওয়াব বাড়ি বগুড়াবাসীর কাছে দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচিত। প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা এসে টিকিট কেটে নওয়াব প্যালেস, প্যালেস মিউজিয়াম এবং ভেতরের বিনোদনকেন্দ্র ঘুরে দেখে।
‘নওয়াব প্যালেস’-এর ক্রেতা আবদুল গফুর বলেন, ‘১ দশমিক ৫৫ একর সম্পত্তির মধ্যে আমি ৬২ শতাংশ, শফিকুল হাসান ৬২ শতাংশ এবং শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি মাসুদুর রহমান ৩১ শতাংশ কিনেছেন। এটি নওয়াবদের পারিবারিক সম্পত্তি। হামদে আলী ও হাম্মাদ আলী চৌধুরীর নামে খারিজও হয়েছে। তাঁরাই সম্পত্তি বিক্রি করেছেন।’
শফিকুল হাসান বলেন, ‘সরকারি নিয়ম মেনেই বাজার দরে “নওয়াব প্যালেস” কেনা হয়েছে।’ মাসুদুর রহমান বলেন, ‘আমরা না কিনলেও অন্যরা কিনতেন। সরকার চাইলে আমরা সম্পত্তি ছেড়ে দিতে রাজি আছি। সরকার চিঠি দিলেই আমরা ছেড়ে দেব।’
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের বগুড়ার আঞ্চলিক পরিচালক নাহিদ সুলতানা বলেন, ‘নওয়াব প্যালেসকে পুরাকীর্তি ঘোষণার জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছিল। এখন এটি রক্ষায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। কোনোভাবেই এমন মূল্যবান ঐতিহ্য ধ্বংস হতে দেওয়া যায় না।’