বঙ্গবন্ধু যে সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন, বর্তমান তার বিপরীত : রেহমান সোবহান

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সমাপ্তিলগ্নে তিনটি প্রশ্ন নিয়ে প্রথম আলো মুখোমুখি হয়েছিল দেশের তিনজন বরেণ্য জ্যেষ্ঠ নাগরিকের। এঁরা প্রত্যেকে মুক্তিযুদ্ধকালে কিংবা এর আগের উত্তাল রাজনৈতিক উত্থান–পতনের সময়ে নানাভাবে জড়িত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের হিসাব–নিকাশ নিয়ে একই প্রশ্ন করা হয়েছিল এই তিনজনকে। তাঁদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ

রেহমান সোবহান, জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ, সিপিডির প্রতিষ্ঠাতা
প্রথম আলো ফাইল ছবি

প্রশ্ন :

জাতি নানা রাজনৈতিক উত্থান–পতনের মধ্য দিয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এসে পৌঁছেছিল। আপনি নিজেও সেই ঘটনাক্রমের অংশ ছিলেন। একাত্তরে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কল্পনাটা আপনার কাছে কেমন ছিল?

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতার লগ্নে আমাদের উচ্ছ্বাস ও আশাবাদ ছিল বাঁধনহারা। মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় সবাই মনে করেছিলেন, এটি একটা দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ হতে চলেছে। এ যুদ্ধে আমাদের এত রক্ত দিতে হবে এবং আমাদের ধ্বংসযজ্ঞের মুখোমুখি হতে হবে। খুব স্বল্পসংখ্যক মানুষই ধারণা করতে পেরেছিলেন যে নয় মাসের মধ্যেই আমরা একটি স্বাধীন দেশ পাব। জাতি গঠনের সম্ভাবনা নিয়ে আমি নিজে খুব আলোড়িত ছিলাম। একই সঙ্গে একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে দেশে ফেরা এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ পুনর্গঠন, নিজেদের হাতে সম্পদের মজুত না থাকা অবস্থায় জনগণের খাদ্যের সংস্থান এবং ভেঙে পড়া একটি অর্থনীতিকে পুনরায় সচল করা—এসব নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলাম। তবে বঙ্গবন্ধুর ভাগ্যে কী হতে চলেছে এবং তাঁর অনুপস্থিতিতে দেশের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক ঐক্য গঠনে কী কী সমস্যা দেখা দিতে পারে, ডিসেম্বরের শেষ দিনগুলোতে সেটিই ছিল আমাদের প্রধান চিন্তার বিষয়।

মুক্তিযুদ্ধাদের অমিত সাহস স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাস্তব করে তুলেছিল, ১৯৭১
ছবি: অমিয় তরফদার

প্রশ্ন :

গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ যে জায়গায় এসে পৌঁছেছে, তার সঙ্গে আপনার কল্পনার রাষ্ট্রের কোথায় মিল, কোথায় অমিল?

স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলনের সময় আমরা সব সময় বিশ্বাস করতাম, যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আমরা দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রাম করছিলাম, তার অধীনে থাকার চেয়ে বাংলাদেশ তার নিজের জনগণতান্ত্রিক শাসনে অনেক ভালো করবে। আমাদের প্রত্যাশা অনেকাংশেই পূরণ হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি পাকিস্তানের চেয়ে দ্রুত বিকশিত হয়েছে। উন্নয়নের প্রতিটি সূচকে, স্বাধীনতার সময় যেসব জায়গায় আমরা পিছিয়ে ছিলাম, তার প্রতিটিতে আজকে আমরা এগিয়ে। এর মধ্যে মাথাপিছু আয়, জিডিপি, রপ্তানি, সর্বস্তরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিস্থিতি, গড় আয়ু, দারিদ্র্যবিমোচন সবকিছু রয়েছে। সব পর্যায়ে—ব্যবসা, আমাদের কঠোর পরিশ্রমী কৃষক, নারী, অভিবাসী ও সুশীল সমাজের গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে—আমরা উদ্যোক্তা তৈরি করেছি। আমাদের নতুন প্রজন্ম ডিজিটাল বিপ্লব ও সংস্কৃতির জগতে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তবে লোভের সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ার কারণে আমাদের উন্নয়নের সুফল চলে গেছে কিছু মানুষের হাতে। অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সামাজিক অসমতা বেড়েছে। দুর্নীতি ও অপরাধপ্রবণতাও বেড়েছে। রাজনৈতিক মদদপুষ্ট একদল ব্যবসায়ী আমাদের সব প্রতিষ্ঠান দখল করে নিয়েছে। বঙ্গবন্ধু যে সমতাভিত্তিক, শোষণ-বঞ্চনাহীন ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন, এ ধরনের একটি বৈষম্যমূলক সমাজের উত্থান তার সম্পূর্ণ বিপরীত।

প্রশ্ন :

সুবর্ণজয়ন্তীর পরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নিরিখে ভবিষ্যতে কোনদিকে আমাদের সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে বলে আপনি মনে করেন?

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের জনগণ গণতন্ত্রের জন্য পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে ২৫ বছর ধরে সংগ্রাম করেছেন। সেই বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং তার বিকাশের জন্য এত সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে, তা আমরা ভাবতেও পারিনি। আমাদের বছরের পর বছর সামরিক শাসনের অধীনে কাটাতে হয়েছে, যা ছিল কল্পনাতীত। আবার বেসামরিক শাসনের সময়ও আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হতে পারেনি। জাতীয় সংসদ কখনো প্রত্যাশা অনুযায়ী ভূমিকা রাখতে পারেনি। আমাদের নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানগুলো আর অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিতে পারে না।
আগামী দশকে আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করা, যেখানে বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার পূর্ণ প্রতিফলন এবং অর্থ ও পেশিশক্তির আধিপত্যের অবসান ঘটবে। আমাদের অর্থনীতিকেও গোষ্ঠীগত পুঁজিবাদীদের খপ্পর থেকে বের হতে হবে, যাতে অর্থনীতি আরও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে ওঠে; যেখানে ক্ষুদ্র কৃষক, শ্রমিক, নারী, অভিবাসীসহ আমাদের সব ধরনের উদ্যোক্তা তাঁদের সম্ভাবনা বিকাশের সমান সুযোগ পান এবং তার মধ্য দিয়ে আমরা একটি সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে পারি। এ ধরনের একটি সমাজে প্রতিষ্ঠানগুলো সবার জন্য কাজ করবে এবং প্রত্যেক নাগরিকের জন্য আইনের শাসন বলবৎ থাকবে। সবার মানবাধিকার রক্ষা করা হবে এবং প্রত্যেক নাগরিক কোনো ধরনের ভয় ছাড়াই তাঁদের মত প্রকাশ করতে পারবেন।