বছরজুড়ে নীরব দুটি কমিটি

  • ৫০টি সংসদীয় কমিটির মধ্যে ৩৯টি কমিটি মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত।

  • এ বছর মাত্র দুটি করে বৈঠক করেছে সাতটি কমিটি। সেগুলো হলো অর্থ, স্থানীয় সরকার, সমাজকল্যাণ, পরিকল্পনা, তথ্য, স্বাস্থ্য এবং ধর্ম মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি।

  • সর্বোচ্চ আটটি করে বৈঠক করেছে মহিলা ও শিশু এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি।

জাতীয় সংসদ ভবন
ফাইল ছবি

বছর শেষ হতে চললেও একটি বৈঠকও করেনি বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। একই রকম নিষ্ক্রিয় থেকেছে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী, প্রতিটি সংসদীয় কমিটির মাসে অন্তত একটি বৈঠক করার কথা। কিন্তু এই দুটি কমিটি পুরো বছর নীরব থেকেছে। অথচ মন্ত্রণালয়ের কাজ পর্যালোচনা, অনিয়ম ও গুরুতর অভিযোগ তদন্ত করা ছিল সংসদীয় কমিটির অন্যতম কাজ।

ওই দুটি কমিটি ছাড়া অন্য কমিটিগুলোও যে খুব একটা তৎপর, তা নয়। চলতি বছর (জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত) সর্বোচ্চ দুটি বৈঠক করেই দায়িত্ব সেরেছে ১০টি সংসদীয় কমিটি।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, সরকার তথা মন্ত্রণালয়ের কাজের জবাবদিহি নিশ্চিত করার জায়গা হলো সংসদীয় কমিটি। কিন্তু কমিটিগুলোর নিষ্ক্রিয়তার কারণে তা হচ্ছে না।

বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এ বছর এখন পর্যন্ত একটি বৈঠকও করেনি।

একাদশ জাতীয় সংসদ যাত্রা শুরুর মাত্র ১০ কার্যদিবসের মধ্যে ৫০টি সংসদীয় স্থায়ী কমিটি করা হয়েছিল। দ্রুততার সঙ্গে কমিটি গঠন করা হলেও কাজের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ কমিটির তেমন তৎপরতা নেই। দু-একটি বাদে কোনো সংসদীয় কমিটিই মাসে অন্তত একটি বৈঠক করার নিয়ম মানছে না।

৫০টি সংসদীয় কমিটির মধ্যে ৩৯টি কমিটি মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত। অন্য কমিটিগুলো বিষয়ভিত্তিক। চলতি বছরের ১১ মাসে (ডিসেম্বর বাদে) মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত এসব কমিটির কোনোটিই প্রতি মাসে নিয়মিত বৈঠক করেনি। করোনাকালে দুই মাসের সাধারণ ছুটি (২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত) বাদ দিলে বছরের বাকি ৯ মাসে প্রতিটি কমিটির অন্তত ৯টি করে বৈঠক করার কথা। কিন্তু এ সময়ে সর্বোচ্চ ৮টি করে বৈঠক করেছে মাত্র ২টি কমিটি। এর একটি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত কমিটি, অন্যটি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি।

সংসদীয় কমিটির প্রধান দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাজ পর্যালোচনা, অনিয়ম ও গুরুতর অভিযোগ তদন্ত করা। বিল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দেওয়া বা সুপারিশ করাও সংসদীয় কমিটির কাজ।

করোনা সংক্রমণের কারণে সরকার ঘোষিত ছুটির দুই মাসে কোনো সংসদীয় কমিটিই বৈঠক করেনি। সংসদ সচিবালয় সূত্র জানায়, ছুটির পর জুন মাসে আইন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি ছাড়া আর কোনো সংসদীয় কমিটি বৈঠক করেনি। মূলত জুলাই মাস থেকে আবার বৈঠক করা শুরু করে বিভিন্ন কমিটি।

ইতিমধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাদে সবকিছুই খুলে গেছে। করোনাকালে স্বাস্থ্যবিধি মেনে জাতীয় সংসদের তিনটি অধিবেশনও বসেছে। কিন্তু অনেক কমিটি এখনো বৈঠক ডাকেনি। পুরো বছর কোনো বৈঠক না করার কারণ জানতে চাইলে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি দবিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তিনি অসুস্থ ছিলেন। পরে করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য মাদ্রাজে যান। এসব কারণে বৈঠক করা সম্ভব হয়নি। ডিসেম্বরে একটি বৈঠক ডাকা হয়েছিল। কিন্তু মন্ত্রী ও সচিবের ব্যস্ততার কারণে তা পেছাতে হয়েছে। আগামী ১২ জানুয়ারি বৈঠক ডাকা হয়েছে।

এ বছরের শুরু থেকেই রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোতে অস্থিরতা ছিল। বকেয়া বেতন-ভাতার দাবিতে বারবার আন্দোলনে নেমেছেন শ্রমিকেরা। ক্রমাগত লোকসানের কথা বলে সরকার ১ জুলাই রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ ঘোষণা করে। তবে এখনো শ্রমিকদের সবাই বকেয়া বুঝে পাননি। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে পাটকলগুলো চালু করার সিদ্ধান্ত থাকলেও ছয় মাসেও তা হয়নি। বেসরকারি খাতের পাটকলগুলো লাভে থাকলেও বিজেএমসির আওতাধীন পাটকলগুলো বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে যাচ্ছে। অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে এই অবস্থা বলে অভিযোগ আছে। পাট নিয়ে এই অস্থিরতার মধ্যে নিষ্ক্রিয় থেকেছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি।

এই কমিটির সভাপতি মির্জা আজম প্রথম আলোকে বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে বৈঠক করা হয়নি। এর আগে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে তাঁর কিছু দায়িত্ব ছিল। এ কারণে সংসদীয় কমিটির বৈঠক করতে পারেননি। আগামী মাসে বৈঠক করবেন।

করোনার সংক্রমণ এবং কেনাকাটায় অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে বছরজুড়ে সবচেয়ে আলোচিত ছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু করোনাকালে এই মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি ছিল একেবারেই চুপচাপ। সংক্রমণের শুরুর দিকে মার্চে একটি বৈঠক করেছিল কমিটি। এরপর আর কোনো বৈঠক হয়নি। করোনাকালে এই কমিটির নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

বৈঠকে আগ্রহ নেই

সংসদ সচিবালয় সূত্র জানায়, জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মাত্র একটি করে বৈঠক করেছে খাদ্য, শিল্প ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। এই সময়ে মাত্র দুটি করে বৈঠক করেছে সাতটি কমিটি। সেগুলো হলো-অর্থ, স্থানীয় সরকার, সমাজকল্যাণ, পরিকল্পনা, তথ্য, স্বাস্থ্য এবং ধর্ম মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি।

তিনটি করে বৈঠক করেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, ডাক ও টেলিযোগাযোগ, শ্রম ও কর্মসংস্থান, বাণিজ্য, কৃষি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি।

চারটি করে বৈঠক করেছে প্রতিরক্ষা, যুব ও ক্রীড়া, ভূমি, শিক্ষা, স্বরাষ্ট্র, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, রেলপথ এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। পাঁচটি করে বৈঠক করেছে আইন, সংস্কৃতি, পানিসম্পদ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। ছয়টি করে বৈঠক করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি।

এই সংসদের সক্রিয় কমিটিগুলোর অন্যতম পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। এই কমিটি সাতটি বৈঠক করেছে। আর আটটি করে বৈঠক করেছে মহিলা ও শিশু এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। মন্ত্রণালয়ভিত্তিক কমিটি না হলেও এ বছর সবচেয়ে বেশি বৈঠক করেছে সরকারি হিসাব কমিটি, ১৩টি।

একাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম বছরের (২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর) পাঁচটি অধিবেশন ও সংসদীয় কমিটির কার্যক্রম নিয়ে গত ৩০ সেপ্টেম্বর একটি গবেষণা প্রতিবেদন (পার্লামেন্ট ওয়াচ) প্রকাশ করেছে টিআইবি। তাতে বলা হয়, অধিকাংশ সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কার্যকর জবাবদিহি করার ক্ষেত্রে ঘাটতি ছিল। সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি নিশ্চিত করার সুযোগ থাকলেও তা প্রত্যাশিত পর্যায়ে কার্যকর ছিল না।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, করোনাকালেও সংসদ চালু ছিল। তাই কমিটিগুলো অন্তত নিয়মিত বৈঠকটি করবে, এটা প্রত্যাশিত ছিল। কমিটির মূল কাজ মন্ত্রণালয়কে জবাবদিহির আওতায় আনা। সেটি হয়নি। বিশেষ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির নির্বিকার থাকা হতাশাজনক। হতে পারে কমিটিগুলো মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম, দুর্নীতি নিয়ে উদ্বিগ্ন নয় বা তাদের প্রাধান্যের মধ্যে পড়ে না। যে কারণে তারা বৈঠকে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এই অনাগ্রহের পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না, কাউকে সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা কি না, সে প্রশ্ন উঠতে পারে।