বদলে যাওয়া ভাসানচর

গত দুই দিন দ্বীপটি ঘুরে মনে হয়েছে, এক মাসের কম সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গারা বেশ মানিয়ে নিয়েছে নতুন পরিবেশে।

দেড় মাস আগে আসমা ও মামুনের সংসারে এসেছে নতুন অতিথি। প্রথম ধাপে কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে আসেন তাঁরা। গতকাল ভাসানচরের আবাসস্থলেছবি: রাহীদ এজাজ

ঠিক ২৬ দিন আগের ভাসানচরের সঙ্গে গতকাল বুধবারের ছবিটাকে ঠিক মেলানো যাবে না। দুটো দৃশ্য একেবারেই আলাদা। ৪ ডিসেম্বর রোহিঙ্গাদের প্রথম দলটি আসা পর্যন্ত এতটা প্রাণচাঞ্চল্য ছিল না বঙ্গোপসাগরের নতুন চরটিতে। গত দুই দিন দ্বীপটি ঘুরে মনে হয়েছে, এক মাসের কম সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গারা বেশ মানিয়ে নিয়েছে নতুন পরিবেশে।

রোহিঙ্গাদের আবাসনকে ঘিরে প্রাণচাঞ্চল্য দেখা গেল। এখানকার ওয়্যারহাউস পেরিয়ে খানিকটা পথ পেরোলেই দেখা যাবে সারি সারি দোকান। আবার ধাপে ধাপে যে গুচ্ছ বাড়িগুলো তৈরি করা হয়েছে, তার মাঝের সড়কেও বসে গেছে দোকান।

গতকাল সকাল নয়টার দিকে রোহিঙ্গাদের ঘরগুলোর সামনে গিয়ে দেখা গেল, এক তরুণ পরোটা ভাজছেন। আর কেউ টেবিলে বসে চিনি দিয়ে পরোটা খাচ্ছেন। কেউ কেউ পরোটা-চিনির প্যাকেট নিয়ে যাচ্ছেন পরিবারের সদস্যদের জন্য।

মাসখানেক আগে যেসব রোহিঙ্গা এসেছে, তারা আছে কেমন, এটা জানতে কিছুটা এগিয়ে হাতের ডানের সারির একটি কামরার দিকে এগিয়ে গিয়ে কথা হলো দিলদার বেগমের সঙ্গে। কুতুপালং শিবিরে থাকতেই কাপড় সেলাই করতেন। সেলাই মেশিন কোথায়, জিজ্ঞেস করতেই জানালেন, নষ্ট হয়ে গেছে। তাই সারাতে দিয়েছেন। তিনি জানান, ২৬ দিন ধরে তিন সন্তান—হেদায়েত, আজিত আর হাসিনাকে নিয়ে স্বস্তিতেই আছেন। আশা করছেন বাকি সময়টাও ভালোই কাটবে।

মিয়ানমারে ফিরবেন কি না, জানতে চাইলে দিলদার বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী থাকে যুক্তরাষ্ট্রে, আমি মিয়ানমার যাব কেন! গেলে তো যুক্তরাষ্ট্রেই যাওয়া উচিত। প্রায় প্রতিদিন স্বামীর সঙ্গে কথা হয় মুঠোফোনে।’

খানিকটা এগোতেই চোখে পড়ল কাঠমিস্ত্রি আবুল হোসেন একটি আলমারি বানাচ্ছেন। তিনি জানান, ছেলে আরাফাতের জন্য পানের দোকানের একটি শোকেস বানিয়ে দিচ্ছেন। রাখাইনের মংডু থেকে ১১ বছর আগে কক্সবাজারে আসেন আবুল হোসেন। শিবিরের জীবনের অনিশ্চয়তা, পাহাড়ের ঢালুতে থেকে দুর্ঘটনার ঝুঁকি, আয় কমে যাওয়া—সবকিছু ভেবেই স্ত্রী আর ছয় সন্তান নিয়ে তিনি ভাসানচরে এসেছেন।

এবার পা বাড়াই মাছের দোকানি আবুল কাশেমের দিকে। নোয়াখালীর সুবর্ণচরের এই বাসিন্দা রুই, তেলাপিয়া, বাটা, চিংড়ি, মৃগেল, পাঙাশ আর সরপুঁটি বিক্রি করছিলেন। আবুল কাশেম বলেন, ২০১৭ সালে এখানে আসি। ভাসানচরে আশ্রয়ণ-৩ প্রকল্পের কাজ শেষে শ্রমিকেরা চলে যাওয়ায় বাজারে বিক্রি কমে গেছে। তাই এখানে এসেছি। তিন সপ্তাহ ধরে গড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকার মাছ বিক্রি করছেন। আগে বঙ্গোপসাগর ঘেঁষে গড়ে ওঠা বাজারে প্রতিদিন তাঁর বিক্রি ছিল ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা।

■ গতকাল দুপুরে গিয়ে দেখা গেল, দুই হাজার রোহিঙ্গার জন্য আলু দিয়ে মুরগির মাংস আর সাদা ভাত রান্না হচ্ছে। ■ আগেরবারের মতো এবারও যেসব রোহিঙ্গা ভাসানচরে এল, শুক্রবার পর্যন্ত তাদের রান্না করা খাবার দেওয়া হবে।

আবুল কাশেমের কাছ থেকে মাছ কিনছিলেন হামিদা বেগম। জানতে চাইলে বলেন, কক্সবাজারের তুলনায় মাছের দাম ভাসানচরে কম। ১৩০ টাকা কেজি দরে তেলাপিয়া মাছ কিনলেন তিনি। ২০১৭ সালের আগস্টের নারকীয় ঘটনার সময় হামিদার স্বামী নিহত হন মিয়ানমারের সেনাদের হাতে।

আগেরবারের মতো এবারও যেসব রোহিঙ্গা ভাসানচরে এল, শুক্রবার পর্যন্ত তাদের রান্না করা খাবার দেওয়া হবে। এরপর প্রতিটি পরিবারকে রেশন, চুলা, গ্যাসের সিলিন্ডার দেওয়া হবে।

গতকাল দুপুরে গিয়ে দেখা গেল, দুই হাজার রোহিঙ্গার জন্য আলু দিয়ে মুরগির মাংস আর সাদা ভাত রান্না হচ্ছে। সকালের নাশতায় দেওয়া হয়েছিল সাদা ভাত, সবজি আর ডিম। সব মিলিয়ে প্রায় ৪০ জন কর্মী রোহিঙ্গাদের খাবার তৈরির সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের সবাই প্রকল্পের দৈনিক কর্মী হিসেবে যুক্ত রয়েছেন। জানা গেছে, গ্লোবাল এহসান রিলিফ নামে একটি সাহায্য সংস্থা রোহিঙ্গাদের খাবারের ব্যবস্থা করেছে।

দুপুরের পর এসে চোখে পড়ল এক নরসুন্দর ট্রিমার দিয়ে এক রোহিঙ্গার চুল কাটছেন। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইলে সমর চন্দ্র মজুমদার বলেন, ‘তিন বছর আগে নোয়াখালীর হাতিয়া থেকে এখানে এসেছি। আর রোহিঙ্গাদের আবাসনের কাছে এসেছি গত বৃহস্পতিবার। বাজারে (বঙ্গোপসাগর ঘেঁষে গড়ে ওঠা দুটি বাজারের একটি) কাজ কমে যাওয়ায় এখানে এসেছি। রোহিঙ্গাদের চুল কাটা আর শেভ করে গড়ে ৬০০ টাকা করে পাচ্ছি। একেবারে শূন্য হাতে বসে থাকার চেয়ে কম আয় খারাপ কী।’

সমর চন্দ্র জানান, চুল কাটতে ৫০ টাকা, ফোম শেভের জন্য ৫০ টাকা আর ক্রিম শেভের জন্য ৩০ টাকা নিচ্ছেন। গত ছয় দিনে রোহিঙ্গারা তাঁর কাছে মূলত চুল কেটেছে। আর যাঁরা শেভ করেছেন, বেশির ভাগই ফোম দিয়ে করিয়েছেন।

বঙ্গোপসাগরের নতুন চরটিতে ঘুরে মনে হলো, জীবন কখনো থেমে থাকে না। সে চলে নিজের নিয়মেই। হয়তো গতির হেরফের হয়। যেমনটা ঘটেছে রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে। প্রাণটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে সাড়ে তিন বছর আগে তারা মিয়ানমারের রাখাইন থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। এ সময়টাতে তাদের আদি নিবাসে ফেরার মতো অবস্থা তৈরি হয়নি। কবে হবে, সেটা এখনো অজানা।